সকল যুগের মানুষই তাদের পূর্ব পুরুষদের চেয়ে নিজেদের সভ্যতর ভেবে এসেছে আর আমরা নিজেদের ভাবি সভ্যতার শিখরে। এখন থেকে পাঁচশ বা হাজার বছর আগের মানুষ আমাদের চোখে অসভ্য; তাহলে এখন থেকে পাঁচশ বা হাজার বছর পরের মানুষ আমাদের কিভাববে? আসলে সময়ের সাথে সাথে মানুষের সভ্যতার ধারনা বিবর্তিত হয়। সৃষ্টির শুরুতে মানুষ ছিল কেবলমাত্র জৈবিক প্রানী, অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সামাজিক প্রাণীতে পরিনত হয়, জীবনের তাগিদ তাকে পরিণত করে অর্থনৈতিক প্রাণীতে। অস্তিত্বের প্রয়োজনে সময় মানুষকে ব্যবহারিক জ্ঞান সন্ধানে ব্র্রত করে। অর্থনীতি ও সমাজ এই দুইয়ের মিথস্ক্রিয়ায় তৈরী হয় এক মহা দানব যার পেটে এখন গোটা মানব সভ্যতা, এই দানবের নাম রাজনীতি। এর পেটে থেকে সভ্যতার ভবিষ্যত অবয়ব বোঝা না গেলেও বর্তমান আকৃতি-প্রকৃতিটা বোঝা যায় খুব সহজেই। এই আকৃতিতে সভ্যতা তার মোট উৎপাদনের সিংহ ভাগ খরচ করে আত্নরক্ষার জন্য, অন্য কথায় নিজেদের ধ্বংস করার জন্য যা খালি চোখেই দেখা যায়। এই আকৃতির ভবিষ্যত প্রকৃতি কি হবে তা জানা গেলে এর গতিও নিয়ন্ত্রন সম্ভব, কারণ পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র প্রাণী যাদের চিন্তার উৎকর্ষতা জেনেটিক্যালি ভবিষ্যত প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়, এটাই প্রাণী হিসাবে মানুষের শ্রেষ্ঠত্য, এজন্য মানুষই একমাত্র প্রাণী যারা তাদের অতীত ইতিহাস জানে।
ব্যক্তি’র আচরনের সামষ্টিক প্রভাব সভ্যতার প্রগতির শক্তি যোগায়, সভ্যতার প্রকৃত রুপ আসলে মানুষের বর্তমানে যা করে তার উপর নির্ভর করেনা বরং যা করতে চায় তার উপর নির্ভরশীল, যে কোন সময়ের পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের মনে সভ্যতার যে প্রতিরুপ, সভ্যতা আসলে সেই দিকেই ধাবিত। কাঙ্খিত সভ্যতা সর্বদাই বর্তমানে অনর্জনযোগ্য একটা ভবিষ্যত কল্প-চিত্র যা মানুষের ধারনাতেই সীমাবদ্ধ। আমাদের বর্তমান সভ্যতা সেই রকম যে রকম আমরা নিকট অতীতে মনে ধারন করেছি। তাই মানুষের বোধ, বিশ্বাস এবং উপলব্ধিতে পরিবর্তনের মাধ্যমে সভ্যতার অভিযাত্রার কাংখিত লক্ষ্য নির্ধারন ও অর্জন সম্ভ্ভব। আমরা মনে প্রাণে সভ্যতার যেমন প্রতিরুপ বিশ্বাস করব, সময় সভ্যতাকে সেই দিকেই ধাবিত করবে। সত্যিকার অর্থে একটা সভ্য পৃথিবীর রূপ বা অবয়ব কি হবে, কি হতে পারে কিম্বা কি হওয়া উচিত সে ব্যাপারে আমার সুষ্পষ্ট প্রস্তাবনা হচ্ছে- “সভ্য পৃথিবী হবে এক ভাষা, এক দেশ এবং এক মুদ্রার পৃথিবী”। কেননা বিশ্ববাসীকে ‘আমরা সভ্য’ এই দাবী বা বোধ সৃষ্টির আগে তাদেরকে নিজেদের মধ্যে বেশীর ভাগ মৌলিক বিষয়ে একাত্ব বোধ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে ভাষা, দেশ এবং মুদ্রা সমত্ব বোধের পরম রূপ। আমার মতে পৃথিবীতে সর্বাধিক ব্যবহৃত অথহীন শব্দ হচ্ছে-‘আমরা’ (বা বিভিন্ন ভাষায় এর প্রতিরূপ)। কারণ বক্তা এবং প্রেক্ষাপট সম্পর্কে শ্রোতার কোন পূর্ব ধারণা জানা না থাকলে বক্তার ‘আমরা’ শ্রোতার মনে কখনই কোন পরিস্কার অর্থ তৈরী করতে পারেনা। ভিন্ন ভিন্ন মানুষের কাছে ‘আমরা’ শব্দের ভিন্ন ভিন্ন অর্থ আবার একই মানুষের কাছে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে “আমরা” শব্দের ভিন্ন ভিন্ন অর্থ। ‘আমরা’ শব্দের প্রকৃত অর্থ সেই বোঝে যে তা’ বলে। পৃথিবীতে একটি মাত্র বা একগুচ্ছ (৬/৭টি) ভাষা জীবিত থাকলে অন্তত ভাষা বা ভাষাগত ক্ষেত্রে ‘আমরা’ মানে সবার কাছে একই রকম বা একই গোত্রের মনে হবে। কারণ মানুষের বুদ্ধি বৃত্তিক বিবর্তনের ফলে মানুষের গড়পরতা মানসিক উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পাবে ফলে ভাষাগুলি কমবেশি সবাই জানবে। ভাষার ক্ষেত্রে বিশ্ববাসী একাত্ব বোধ করলে রাষ্ট্রীয় ভৌগলিক সীমা রেখার বিভাজন সত্ত্বেও পারস্পরিক নৈকট্য বোধ করবে এবং নিজেদেরকে এই গ্রহের সমবাসিন্দা বলে ভাবতে পারবে, তখন মানুষ হবে শ্রেষ্ঠতম ‘আমরা’, সবাই বুঝবে সবার ‘আমরা’। আর সবাই যখন জানবে আমরা সবাই এইগ্রহের সমবাসিন্দা তখন এই “আমরাত্ব” বোধই ভবিষ্যতের প্রকৃতি নির্ধারন করবে।
মানব সভ্যতার সেরা সৃষ্টি হলো তার নিজের ভাষা। কেননা ভাষার কারণেই মানুষ আজ মানুষ, অনন্য, অন্য প্রাণীর চেয়ে আলাদা। ভাষা বিষয়ক কিছু তথ্য-উপাত্ত রীতিমত রোমাঞ্চকর ও শিহরন জাগানিয়া। ‘এটলাস অব দি ওয়ার্ল্ডস ল্যাঙ্গুয়েজেস ইন ডেন্জার অব ডিসএপিয়ারিং’ এর হিসাব মতে বর্তমানে পৃথিবীতে জীবিত ভাষার সংখ্যা ৬৮০৯ টি যার অর্ধেক আগামী ৫০ বছরের মধ্যে হারিয়ে যাবে। ইউনেস্কোর এক গবেষনা প্রতিবেদন অনুযায়ী আগামী ২০৯৯ সালের মধ্যে প্রায় ৩ হাজার ভাষা পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে। ভাষা বিজ্ঞানী মাইকেল ক্রাউসের মতে আগামী ১০০ বছরের মধ্যে বর্তমানের ৯০ শতাংশ ভাষাই মরে যাবে। যদি প্রতি ১০০ বছরে ৯০ শতাংশ হারে ভাষা মৃত্যুর এই হার পরের শতকেও অব্যাহত থাকে তবে আগামী একশ’ বছর পরে পথিবীতে জীবিত ভাষার সংখ্যা হবে ৬৮১ টির মত, দুইশ’ বছর পর পৃথিবীতে জীবিত ভাষার সংখ্যা হবে আটষট্টি টি এবং তিনশ’ বছর পর ভাষা হিসাবে জীবিত থাকবে মাত্র ৬/৭ টি যদি না প্রগতির এই গতি ও প্রকৃতির কোন পরিবর্তন না হয়।
সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে মানুষ নানা জাতি গোষ্ঠিতে বিভক্ত হয়ে যায় ফলে তাদের ভাষাতেও অনিবার্য ভাবে ভিন্নতা আসে। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষা ভাষি মানুষের ভৌগলিক বিন্যাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে যে, সহজে যোগাযোগ স্থাপনযোগ্য অঞ্চলের মানুষের ভাষা সাধারণত সমগোত্রীয়। আবার ভৌগলিক কারনে নির্দিষ্ট অঞ্চলের সীমাবদ্ধ এলাকার মানুষের ভাষা মোটামুটি একই। তাই একথা নিশ্চিন্তে অনুমান করা যায় যে, মানুষে মানুষে পারস্পরিক যোগাযোগ যত বেশী হবে ভাষার ভিন্নতা তত কম হবে। সময়ের সাথে সাথে পৃথিবীতে ভাষার সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান। আমার মনে হয় একথা ভাবা অযৌক্তিক হবে না যে, যোগাযোগ ব্যবস'ার নিরন্তর উন্নয়নের ফলেই মানুষের ভাষাগত ভিন্নতা ক্রমহ্রাসমান। আগামীতে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও উন্নত ও সহজ হবে, সেই সাথে মানুষের ব্যক্তিক পরিভ্রমনের পরিমান ও পরিধি অনেক বেড়ে যাবে কিম্বা ব্যক্তিক পরিভ্রমনের প্রয়োজনই হবেনা। ফলে হয়তো দেখা যাবে যে, আগামী একশ বছরে প্রাক্কলিত হিসাবের চেয়ে অনেক বেশী ভাষা মরে যাবে এর অনিবার্য পরিনতি হিসাবে সংখ্যা লঘু ভাষা ভাষির সংখ্যা দ্রুত লয়ে কমতে থাকবে। এটা সময়ের কারণেই সময়ের জন্য সময় কর্তৃক সংগঠিত হবে। হয়তো সময় যোদ্ধারা এর গতি কিছুটা মন'র করতে পারবে কিন' গতি রোধ করতে পারবেনা সময়ের জন্যেই।
মানুষ হিসাবে আমরা সবাই ক্রমান্বয়ে সভ্য হচ্ছি এবং সভ্য হতেই আমরা চাই, সভ্যতার পথে আমরা সবাই বিরতিহীন অভিযাত্রী। আর এজন্য দ্রুত সভ্য হওয়ার একমাত্র পথই হচ্ছে এই এককীকরন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা। আর এক্ষেত্রে আমাদের প্রথম করনীয় হচ্ছে পৃথিবীতে ভাষাগত অভীন্নতা সৃষ্টি করা। যে কথা বলতে পারেনা তারও নিজের ভাষা আছে এবং একথার সত্যতা সম্পর্কে প্রমানের কোন প্রয়োজন পড়েনা। তার মানে সাধারন ভাবে আমরা ভাষা বলতে যা বুঝি (মুখের কথা) তা ছাড়াও ভাব প্রকাশযোগ্য ভাষা হতে পারে এবং তা সার্বজনীন। কারণ বোবারা কারও কাছে ভাষা না শিখলেও তাদের ভাষা অনেকটা একই বা সমগোত্রের। শব্দই একমাত্র কথা বলার উপায় নয়, আর মানুষ উচ্চারিত সব শব্দই কথা নয়। যে শব্দ কানের সদর থেকে মনের অন্দরে প্রবেশ করে অনুভূতির পর্দায় দৃশ্যকল্পের অনুরনণ তুলতে পারে তাই কথা। যে জন যে ভাষা জানে না, সেই ভাষায় কথা তার কাছে শব্দ ছাড়া আর কিছুই নয়। আমি দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি পরিকল্পিত ভাবে বৈজ্ঞানিক উপায়ে এমন ব্যবহারিক ভাষা অবশ্যই উন্নয়ন করা সম্ভব যা সহজেই সবার কাছে বোধগম্য হবে, যা হবে বোবাদের ভাষা বা ইশারা ভাষা হতে উন্নত স-রের সরল ভাষা। সভ্য হওয়ার জন্য মানুষে মানুষে সমনাগরিকত্ব বোধই একমাত্র উপায়। সমভাষা বোধ বা ভাষাগত ঐক্য সমনাগরিকত্ব বোধকে আরও ত্বরান্বিত, শক্তিশালী, দৃঢ় এবং স্থায়ী করবে যা যে কোন ভৌগলিক সীমানায় প্রযোজ্য।
বর্তমানে পথিবীর সকল ভাষাতেই কিছু না কিছু ইংরেজী শব্দ আত্নস্থ হয়ে ঐ ভাষার সঙ্গে মিশে আছে। এই শব্দ মিশ্রনের বর্তমান হার নিয়ে কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না, তবে এই মিশ্রিত শব্দের মধ্যে যে গুলি প্রায় সব ভাষাতেই আছে এর হার সময়ের সাথে সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং পাবে, আর এভাবেই ক্রমান্বয়ে পূর্নতা পাবে একক সাধারন ভাষার ব্যবহারিক রূপ। ভাষাগত ভাবে মানুষ যদি একাত্ব হয়, মনের দেশাত্ববোধ যদি দুর নাও হয় তবু মুদ্রা তার ব্যবহারিক প্রয়োজনে একক বা একক সধারণ গুচ্ছের (৪/৫টি) রূপ লাভ করবে। এটা সময়ের অনিবার্য পরিণতি যা সময় মতই ঘটবে। আমি দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি পৃথিবী কোন না কোন একদিন একক ভাষার একক রাষ্ট্রে পরিণত হবে সভ্যতার পরিপূর্ন রূপ পরিগ্রহ করার জন্য আর এর অনিবার্য ফলাফল হিসাবে মুদ্রায় অভীন্নতা আসবে। বর্তমান পৃথিবীর দিকে তাকালে যে চিত্র পাওয়া যায় তা এই মতকে প্রচ্ছন্ন ভাবে সমর্থন করবে। কেননা বর্তমানে পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশই কোন না কোন আঞ্চলিক জোট ভূক্ত, সময়ের কল্যানে এবং প্রয়োজনে অদুর ভবিষ্যতে সমমনা এবং সমস্বার্থের আঞ্চলিক জোট গুলির মধ্যে পারস্পরিক মানসিক দুরত্ব কমতে থাকবে এবং কালের পরিক্রমায় নিজেদের মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠবে। এই ধারা নিরন-র চলতে থাকবে, আর মুদ্রা তখন অসি-ত্বের প্রয়োজনেই একক সাধারন রূপ লাভ করবে।
একটি কথা বিশেষ ভাবে উল্ল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আমরা প্রায়ই ভাষা ও সংস্কৃতিকে একাকার করে ফেলি, ভুলে যাই ব্যবধান। বোবার তো আমাদের মত তথাকথিত ভাষা নেই, তাই বলে কি তার কোন সংস্কৃতি নেই? ভাষা হচ্ছে আমাদের ভাব প্রকাশের মাধ্যম যার প্রকাশ শব্দ বা ইশারায়, আর সংস্কৃতি হচ্ছে মানুষের পৌনঃপুনিক আচরনগত বৈশিষ্ট্য যার প্রকাশ মানবিক আচারে। কোন বিশেষ গোষ্ঠির মধ্যে ভাষাগত ভীন্নতা থাকলেও তাদের সংস্কৃতিতে থাকতে পারে অভিন্নতা, আবার ভাষা এক হলেও থাকতে পারে তাদের সংস্কৃতিতে ভীন্নতা। সংস্কৃতি কোনক্রমেই ভাষা নির্ভর নয় বরং ভাষা নিরপেক্ষ। ভাষা হচ্ছে জীবন প্রকাশের মাধ্যম, সংষ্কৃতি জীবন প্রকাশের ধরন, আর সভ্যতা হলো জীবনের রং।
শিক্ষা দান এবং গ্রহনের ক্ষেত্রে ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। যতদুর জানা যায় শিৰা ব্যবস্থা কোন ওহি নাজেলের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়নি বরং মানুষের প্রয়োজনে মানুষই শিৰা ব্যবস্থার প্রচলন করেছে, আর আমাদের বর্তমান শিৰা ব্যবস্থা সহস্র বছরের বিবর্তনের ফসল। যে ভাষাতেই শিক্ষা দেয়া হোক না কেন তাকে কার্যকর, সার্থক এবং ফলদায়ক করতে হলে তা শিক্ষার্থীদের জন্য সহজে সাবলীল ভাবে বোধগম্য রুপে উপস্থাপন করতে হবে। এক্ষেত্রে মাতৃ ভাষায় শিক্ষাদানই একমাত্র উপায় নয়, যদিও তা অন্যতম উপায়। যে ভাষাতেই শিক্ষা দেয়া হোকনা কেন তাকে সত্যিকার অর্থে কার্যকর করতে হলে শিক্ষার্থীদের জন্য তা সহজ বোধ্য এবং সহজগম্য ভাবে উপস্থাপন করতে হবে। এক্ষেত্রে একটি বিষয় স্মরন রাখা দরকার যে, মানুষ যা কিছু শেখে তা তার পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমেই শেখে। আর মানুষের সব ইন্দ্রিয়ের গ্রহণ ক্ষমতা সমান নয়। সাধারন ভাবে
মানুষের ইন্দ্রিয় সমুহের শিক্ষন ক্ষমতা নিম্নরূপ ঃ-দর্শন-৮৩%, শ্রবন-১১%, স্পর্শ-০২%, স্বাদ-০১% এবং গন্ধ-০১%। আর মনে রাখতে পারে যা পড়ে তার ১০%, যা শোনে তার ২০%, যা দেখে তার ৩০%, যা দেখে ো শোনে তার ৫০% এবঙ যা বলে ো করে তার ৯০%। এই তথ্যের যথার্থতা সাধারন ভাবেই বোঝা যায়, আমরা যত দুর পর্যন- দেখতে পাই তার চেয়ে কম দুরত্বে শুনতে পাই, স্পর্শ করতে পারি আরও কম দুরত্বে, স্বাদ আর গন্ধ নিতে পারি একেবারেই নিকটের। উপরোক্ত তথ্য হতে একথা নিশ্চিনে- বলা যায় যে, শিক্ষা ব্যবস্থা যত বেশী দর্শন নির্ভর হবে তা শিক্ষার্থীদের জন্য গ্রহণ করা তত সহজ হবে, কারণ মানুষের দর্শন ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতা অন্য যে কোন ইন্দ্রিয়ের চেয়ে বেশী। আর এই পঞ্চ ইন্দিয়ের মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্যের উৎপাদিত পন্যই জ্ঞান। জ্ঞান আবার এ্যামিবার মত নিজেই নিজের উৎপাদন বাড়াতে পারে জ্যামিতিক হারে উপরন' পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতা বাড়ায় গানিতিক হারে। শিক্ষা হচ্ছে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের ব্যবহার ও ক্ষমতা বৃদ্ধির উপায়।
তাই ভাষাগত ভিন্নতার চেয়ে শিৰার বিষয়বস্তু ও তা উপস্থাপনগত ভিন্নতাই বেশী গুরুত্বপূর্ন। অথচ শিক্ষা ব্যবস্থায় এ বিষয় গুলির প্রতি মনোযোগ খুবই কম। বরং এ প্রসঙ্গে সমপ্রতি কানাডার ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা তিরিশ থেকে আটাশি বছর বয়সী একশত চার জন মানুষের উপর পরিচালিত জড়িপে একাধিক ভাষা সংক্রান্ত ব্যাপারে যে ফলাফল পান তা স্মরন করা যেতে পারে। গবেষকরা বলেন যে, ছোট বেলায় মাতৃ ভাষা শেখার পর যদি বেশ দ্রুত দ্বিতীয় কোন ভাষা শেখা যায় তাহলে তা পরবর্তী জীবনে মানসিক দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। দ্বিতীয় ভাষাটি মস্তিস্কের ভাষা অঞ্চলে বেশ কিছু স্নায়ুবিক সার্কিট তৈরী করে যা স্মৃতিচারন, গননা, বিষয় বস'র উপলব্ধি প্রভৃতি বিষয়ে উৎকর্ষতা সাধন করে। লাভের উপর লাভ হিসাবে নিউরনের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, ফলে ভাষাগত অভিন্নতা কোন ভাবেই তার সংস্কৃতি বা শিক্ষাকে নেতিবাচক ভাবে প্রভাবিত করেনা বরং তা সংস্কৃতি ও শিক্ষার ব্যাপকীকরনের সহায়ক ক্ষেত্র তৈরী করে। সভ্যতার ক্রমবিকাশের এই নিরন্তর যাত্রাকে ত্বরান্বিত করতে হলে যত বেশী এবং যত দ্রত সম্ভব অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ভাষা ভাষি মানুষদের তুলনামুলক বৃহত্তর ভাষা ভাষি মানুষদের ভাষার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে যা প্রকৃতিগত ভাবেই অবিরাম ঘটে চলেছে যাদৃচ্ছিক ভাবে।
আমার মতে পৃথিবীর সর্বকালের সর্ববৃহৎ সামাজিক অন্যায় যা আজও বহাল তবিয়তে টিকে আছে তা হচ্ছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা স্বয়ং নিজেই, বৃহত্তর অর্থে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সকল ক্ষেত্রেই। আমার অতি মূল্যবান জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন অংশের প্রায় পুরোটাই ভাওতা দিয়ে কেড়ে নিচ্ছে, আমার কিছুই করার নাই। কারণ সবাই বলে এটাই নাকি দরকার। কিন্তু কেন? কারণ আমার একটাই জীবন, এই জীবনকে অর্থবহ করতে হলে নিদানপক্ষে সহজে বেচে থাকতে হলে শিক্ষা দরকার। কিভাবে শিক্ষা গ্রহণ করা যাবে? পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ শিক্ষা উপকরন ব্যবহার করে। কিন্তু কি শিক্ষা দরকার? স্বামর্থকে সক্রিয়, দুর্বলতাকে অতিক্রম, বাধাকে এড়িয়ে সুযোগের সবোচ্চ ব্যবহারে জীবনের সর্বোচ্চ বিকাশের কৌশল জানার জন্য শিক্ষা দরকার। কোথায় শিক্ষা গ্রহণ হবে? প্রকৃতির কাছে থেকে। কিন্তু এই প্রাকৃতিক শিক্ষাকে কার্যকর, লক্ষ্য কেন্দ্রীক ও গতিশীল করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কাঠামো দরকার। প্রাকৃতিক শিক্ষার শ্রেণী মাপার কোন ব্যবস্থা না থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শ্রেণী মাপার অমানবিক, অবৈজ্ঞানিক, অসামাজিক ও করুন একটা ব্যবস্থা আছে। এই ব্যবস্থায় ব্যক্তি নিরপেক্ষ ভাবে সময় দিয়ে শ্রেণী মাপা হয়, অর্থাৎ প্রত্যেককেই একই শ্রেণীতে একই সময় পড়তে হয়। অথচ এটা আজ দিবালোকে প্রমানিত সত্য যে প্রত্যেকটি মানুষই স্বতন্ত্র ও মৌলিক। প্রত্যেকের ভীন্ন স্বামর্থ,ভীন্ন সক্ষমতা ও ভীন্ন সম্ভাবনা এবং প্রত্যেকের শিক্ষনের গতি ও পদ্ধতি ভীন্নভীন্ন। আবার অধুনা পদার্থ বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সময় নিজেও ব্যক্তি নিরপেক্ষ নয়। তাহলে কোন যুক্তিতে এই ব্যবস্থা বহাল থাকতে পারে। পৃথিবীতে কোন সামাজিক অন্যায়ই চিরকাল টিকে থাকেনি, কারণ সময়ের আবর্তে মানুষের অন্যায়বোধ সদা বিবর্তনশীল। একসময় না এক সময় মানুষ প্রকৃতির নিয়মেই সামাজিক অন্যায়কে অন্যায় বলে অবচেতন মনে বিশ্বাস করে, আর সময় মানুষকে অবচেতন মনের বিশ্বাসের দিকেই ধাবিত করে।
ভাষাগত ঐক্যের মাধ্যমে পৃথিবীর সভ্যতার পথে পরিভ্রমনের গতিকে কাঙ্খিত দিকে ত্বরান্বিত করতে হলে আদি বাসি বা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠি বা সংখ্যা লঘু ভাষা ভাষিদের আদিম চিন্তন বৃত্তে আবদ্ধ রেখে তাদের আদি বাসি বানিয়ে রাখার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত না করে ভাষাগত ভাবে তাদেরকে মূল স্রোত ধারায় আনতে হবে। এতে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি তো ক্ষতিগ্রস্থ হবেই না বরং অন্যেরা সেটা ভাষাগত ভাবে সহজেই বুঝতে পারলে পরস্পরের সংস্কৃতির প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি হবে। রাষ্ট্রের এককীকরন প্রক্রিয়া বর্তমান সভ্যতার কলংক টিকা সামরিক শক্তিকে ক্রমান্বয়ে দূর্বল করতে করতে বিলুপ্ত করবে যা এই গ্রহের সৌন্দর্য্য ও ঐশ্বর্য্যকে মানুষের জন্য আরও সর্বব্যাপি সহজগম্য ও সর্বজনে উপভোগ্য করবে। মুদ্রার এককীকরন (যা ভাষা একিভ'ত হওয়ার অনেক আগেই ঘটবে) এবং তার ধারাবাহিকতায় ডিজিটালকরন পৃথিবীর আর্থিক ও অর্থনৈতিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার টেকসই ভিত্তি তৈরী করবে যা সামাজিক ন্যায় বিচারের সহায়ক ক্ষেত্র তৈরী করবে এবং তা নিশ্চিত করবে সভ্যতার ধারাবাহিক ক্রমবর্ধমান প্রগতি। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থাতেই বিশ্বের মুদ্রা ব্যবস্থা প্রায় শতভাগ ডিজিটালকরন সম্ভব তেমন কোন বাড়তি প্রচেষ্টা ছাড়াই। আর ডিজিটাল মুদ্রা ব্যবস্থায় সকল লেন-দেনই সনাক্ত করা সম্ভব যা অনৈতিক লেন-দেন বন্ধের একমাত্র উপায়। সভ্যতাকে ধর্ম বা দর্শন দিয়ে নিয়ন্ত্রন করার চেয়ে সকলের চাওয়া সকলের নিকট সমভাবে বোধগম্যকরনই সহজ পন্থা, তাহলেই মানবিক অধিকারগুলি প্রতিষ্ঠিত হবে আর সভ্যতার গতিই তখন তার প্রগতিকে নিয়ন্ত্রন করবে।
পৃথিবী সভ্য হওয়ার পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হচ্ছে পৃথিবীর রাষ্ট্র ব্যবস্থা। এই গ্রহ হচ্ছে রাষ্ট্র নামক বন্দীশালার সমষ্টি। অদৃশ্য পিঞ্জরে সবাই নিয়মের জিঞ্জির বাধা, সবাই এই রাষ্ট্র শৃংখলে আবদ্ধ। কিন্তু একজন সভ্য মানুষকে শৃংখলে আবদ্ধের প্রয়োজন হয় না আর প্রয়োজন হলে সে সভ্য থাকেনা, সে থাকবে সকল শৃংখলের উর্ধে তার অন্তর্নিহিত অপার সম্ভাবনার সর্বোচ্চ বিকাশে মশগুল। তাই রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও সভ্য পৃথিবীর এক সাথে সহাবস্থান অযৌক্তিক ও অসম্ভব। কিন্তু মানুষের মগজে বর্তমানে রাষ্ট্র চিন্তা এত প্রবল যে, এর বাইরে সে কোন চিন্তাই করতে পারেনা, সে চিন্তার দাসত্বে সময়ের শৃংখলে বন্দী। লেনিন নিজেও বিশ্বাস করতেন “রাষ্ট্র থাকলে নাগরিকের স্বাধীনতা থাকে না, আর স্বাধীন সমাজে রাষ্ট্র থাকতে পারেনা”। অথচ এখনকার রাষ্ট্র গুলোকে এই গ্রহের স্থানীয় প্রশাসনিক ও উন্নয়নের একক ভাবলেই পৃথিবী রাষ্ট্রহীন হয়ে যায় তেমন কোন ভৌত বা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন, পরিমার্জন, সংযোজন, বিয়োজন বা প্রতিস্থাপন ছাড়াই। কারণ রাষ্ট্রের অস্তিত্ত্ব যতনা বেশী মুর্তমান তার চেয়ে অনেক বেশী বিমুর্ত। এক্ষেত্রে মুলত মানুষের মানসিক পরিবর্তন ঘটালেই রাষ্ট্রের যন্ত্রণা থেকে সভ্যতা মুক্ত হয়, রাষ্ট্র মুক্ত হয় অপর রাষ্ট্রের জুজুবুড়ির ভয় হতে, অর্থনীতি মুক্ত হয় রাষ্ট্রের কাল্পনিক শত্রু হতে আত্নরক্ষার বিশাল ব্যয় বিলাস হতে। এখন পৃথিবীতে অসংখ্য দরিদ্র মানুষ থাকলেও সভ্য পৃথিবীতে থাকবেনা কোন দরিদ্র মানুষ, কেবল ‘অভাব’ ছাড়া পৃথিবীতে আর কোন কিছুর অভাব থাকবেনা। আমি ব্যক্তিগত ভাবে নিজেকে কোন দেশের বাসিন্দা ভাবার চেয়ে এই গ্রহের প্রায় সারে ছয়শত কোটি আমার প্রজাতির প্রাণীদের একজন ভাবতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ বোধ করি এবং নিজেকে অনেক বেশী ঐশ্বর্য্যবান মনে হয়। কারণ এই মহাবিশ্বের মোট আয়তনের মাত্র চার শতাংশ ‘বস্তু, আর সমস্ত বস্তুর মধ্যে উৎকৃষ্টতম বস্তুর সমাহার হচ্ছে পৃথিবী নামক এই গ্রহ যার জন্মই প্রাচুর্য্যে কারণ স্টিফেন হকিং তার A Brief History of Time বইতে এটা বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমান করেন যে, মহাবিশ্বে আমাদের বসবাবের এই অংশই বস'গত ভাবে সর্বাধিক প্রাচুর্যময় প্রকৃতিগত ভাবেই। পক্ষান্তরে আমি যখন কোন নির্দিষ্ট দেশের বাসিন্দা তখন বড়ই দরিদ্র, অভাবী, অসহায়, বঞ্চিত, শোষিত এবং অনাহুত।
আমাদের আদি পুরুষের জন্মের মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল মানব জাতির সভ্যতার পথে নিরন্তর এ যাত্রা। মহাকালের পরিক্রমায় মানুষের বুদ্ধি বৃত্তিক ও মানবিক উৎকর্ষতা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়ে তা বর্তমান কালে ও বর্তমান রুপে আমাদের সামনে উপস্থাপিত হয়েছে আগামী প্রজন্মের নিকট সঞ্চালনের জন্য। প্রকৃত পক্ষে কোন মানুষই বিচ্ছিন্ন কোন মানুষ নয়। জেনেটিক্যালি মানুষের পূর্ব পুরুষের মানসিক উৎকর্ষতা উত্তর পুরুষে স্থানান্তরিত/সঞ্চালিত হয়। সভ্যতার ক্রমবিকাশের অবিরাম এই যাত্রায় রিলে দৌড়ের মত এক প্রজন্ম যেখানে শেষ করে পরের প্রজন্ম সেখান থেকে শুরু করে। মানুষের সঙ্গে পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণীর পার্থক্য আসলে এখানেই। আজকের প্রজন্মের মনে সভ্যতার যে প্রতিরূপ, আগামী প্রজন্মের জীবনধারায় তার প্রকাশ অবধারিত। আর সময় তার সাময়িক প্রয়োজনে সময় মত সময়-যোদ্ধা তৈরী করে সভ্যতার দিকপাল হিসাবে। তাদের চোখে বিশ্ব দেখে সভ্যতার বৈশ্ব্যিক রূপ। আর বিশ্ববাসী সেভাবেই সভ্যতাকে অবচেতন চেতনায় ধারন করে। আর সময় সেভাবেই সময় মত সূযোগ সৃষ্টি করে সময় যোদ্ধাদের জন্য যাদের অর্জন এই সভ্যতার প্রগতি।
মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অভ্যস্থতা, সে অবচেতন ভাবেই সব কিছুতে তার মত করে অভ্যস্থ থাকতে চায়। এমনকি ভাবনা-চিন্তার ক্ষেত্রেও তার একটা অভ্যস্থতা তৈরী হয়। এই অভ্যস্থতা মানুষের মনে কিছু বিশ্বাসের জন্ম দেয় যা তার অবচেতন চেতনাকে চালিত করে। যেমন আমরা সবাই জানি এবং মানি যে সময় চলমান, তা কখনো স্থীর নয়, এর গতি হ্রাস-বৃদ্ধি করা বা চলে যাওয়া সময় ফিরিয়ে আনা যায় না। তাই স্বাভাবিক ভাবেই সময়ের অতীত ও ভবিষ্যত কাল ছাড়া অন্য কোন কাল হতে পারেনা এবং বর্তমান কাল অসম্ভব, কারন সময় কখনো স্থীর হয় না এবং তা কেবল অতীত হলেই আমরা উপলব্ধি করতে পারি। সময়ের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বর্তমান কাল অসম্ভব হলেও আমরা অতীত ও ভবিষ্যতের চেয়ে বর্তমানেই বেশী বিশ্বাসী এবং এর প্রভাব এত বেশী যে অতীত আমাদের মনে থাকতে চায় না ও ভবিষ্যত মনে থাকার যায়গা পায়না। কাল্পনিক বর্তমান কালের অস্তিত্ব কেবল মাত্র আমাদের চেতনায় যা মানুষের অভ্যাস জনিত চিন্তার ফসল। এধরনের অবচেতন অভ্যস্থতাই বৃহত্তর পরিসরে সভ্যতার প্রচ্ছন্ন কাঠামো নির্মান করে যা সচেতন ভাবে বিনির্মিত হয় বর্তমানের উপলব্ধিতে। মুলত বেশীর ভাগ মানুষের সামষ্টিক স্বপ্ন সভ্যতার দিক নির্ধারন করে।
প্রত্যেক মানুষের মনের গহীনে একটি গোপন কুঠুরী থাকে যেখানে থাকে তার অবসরের প্রিয় কিছু ভাবনা, জীবনের প্রিয় কিছু স্বপ্ন, যাদেরকে কেন্দ্র করে তার সমস- কর্ম আবর্তিত হয়। সে তার সমস্ত স্বত্তা দিয়ে এই স্বপ্ন গুলিকে লালন করে। এই স্বপ্ন গুলিতে কোনভাবে আঘাত লাগলে শুরু হয় হৃদয়ে রক্ত ক্ষরন। রক্ত ক্ষরনের মাত্রা বেড়ে গেলে স্বপ্ন গুলি বিবর্ন-ধূসর হয়ে যায়। তখন সে নানান উছিলায় নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করে, যাতে সে স্বপ্ন দেখার সুযোগ না পায়। তবুও তার বিবর্ন স্বপ্ন গুলি মাঝে মাঝে দীর্ঘ নিঃশ্বাস হয়ে উকি দেয়। প্রিয় স্বপ্ন গুলি জিবন্ত এবং চলমান। জীবনের বিভিন্ন স্তরে এই স্বপ্ন গুলি বিভিন্ন রকম আবার একই স্তরে একই সময়ে একাধিক স্বপ্ন ও সহাবস্থান করে। মন যখন ক্লান্ত--শ্রান্ত হয়ে যায় তখন এই স্বপ্ন গুলির কাছে আশ্রয় নিয়ে তার স্নীগ্ধ-শীতল স্পর্শে তরতাজা হয়ে উঠে ফলে জীবন হয়ে ওঠে গতিময়। প্রকৃতপক্ষে এই গতিময়তা অনন্ত সম্ভাবনার দিকে তার প্রিয় স্বপ্ন গুলিকে কেন্দ্র করে। তাই মানব জীবন জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বিরামহীন প্রবাহমান প্রিয় স্বপ্ন গুলির পূর্নতার দিকে, অন্য কথায় প্রশান্তিময় জীবনের লক্ষ্যে সূখানুভুতি কামনায়। এইস্বপ্ন গুলি মানব মনের গোপন কুঠরিতে শিশুকাল থেকেই ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে, তার ‘চেনা’ পরিবেশ ও প্রকৃতির উপলব্ধি হতে। প্রিয় স্বপ্ন গুলি অত্যন্ত বৈচিত্রময়, ঠিক মানব জীবনের মতই। জীবনের প্রতিটি ঘটনা এবং প্রিয় স্বপ্ন পরস্পর পরস্পরকে দারুনভাবে প্রভাবিত ও আলোড়িত করে। আমাদের সামনে যা কিছু উপস্থাপিত হয় তাই ঘটনা। এই ঘটনাবলীর মধ্য থেকে মন স্বাধীন ভাবে কিছু বিষয় অবসরের ভাবনার জন্য রেখে দেয় যা থেকে জন্ম নেয় স্বপ্ন। এই স্বপ্ন গুলির মধ্য দিয়েই সে তার ভবিষ্যতকে দেখে আর সেভাবেই নিজেকে উপলব্ধি করে। যদি কোন কারনে প্রিয় স্বপ্ন গুলি তার কাছে অপ্রিয় হয়ে ওঠে তখন জীবন হয়ে যায় বিষাদময়, ক্লান্তিকর, অর্থহীন। আর সে তখন বেচে থাকার জন্য বেচে থাকে জীবনের জন্য নয়, মানুষ হয়ে যায় ’একা’, স্বপ্নহীন। যার অনিবার্য পরিণতি তাকে কেবল স্বার্থপরই করেনা, সেই সাথে তাকে করে ফেলে ‘ঝোক’ প্রবন যার প্রভাব অন্যদের প্রতি বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই নেতিবাচক যার চাক্ষুষ প্রমান বর্তমান পৃথিবী। তাই আসুন- স্বপ্ন দেখি, স্বপ্ন দেখাই,স্বপ্ন দিয়ে স্বপ্ন বুনাই। স্বপ্ন ওড়াই, স্বপ্ন পোড়াই,স্বপ্ন দিয়ে স্বপ্ন জড়াই। স্বপ্ন বুনি, স্বপ্ন বেচি,স্বপ্নে গড়ি স্বপ্নপুরি। আর তাহলে সময়ই আমাদের অবচেতন স্বপ্নকে বাস্তবে পরিনত করবে সময়মত।
মানব সভ্যতার এই অভিযাত্রাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য সময়ের সাহসী কিছু সন্তান সময়ের গতানুগতিক চিন্তন বৃত্ত থেকে বেড়িয়ে এসে মাঝে মাঝে এগিয়ে নিয়ে যায় সবাইকে। পৃথিবীর বেশীর ভাগ কালোত্তীর্ন উদ্যোগই যা সভ্যতার অভিযাত্রায় সময-দৌড়ে সিড়ি হিসাবে ভ'মিকা পালন করেছে তার বেশীর ভাগই প্রথম থেকে সার্বজনীন ভাবে সমাদৃত হয়নি, আর বর্তমান সভ্যতার অগ্র গতিতে কোন বিশেষ শ্রেনী বা গোত্রের সমষ্টিগত প্রচেষ্টার চেয়ে একক মানুষদের অবদানই বেশী। কারন যত বড় ঘটনাই হোকনা কেন তার(স্বপ্ন) সূত্রপাত কোন না কোন একক ব্যক্তি হতেই শুরু হয় (কারন জৈবিক সীমাবদ্ধতার কারনে মানুষ যৌথ ভাবে চিন্তাই করতে পারেনা, স্বপ্নতো দুরের কথা), অন্যদের মধ্যে সে স্বপ্ন যত বেশী সঞ্চারিত হয় কিম্বা অন্যদের স্বপ্নের যত কাছাকাছি হয় তা ততোই বাস্তবতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। তবে মানুষ চাইলেই অংশীদারী স্বপ্ন গড়ে তুলতে পারে, এবং তা ধারনও করতে পারে যা বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করে প্রকৃতি নিজেই।
পরিশেষে স্পষ্ট ও দৃঢ় ভাবে বলতে চাই সভ্যতার শুরু হয়েছিল এক দেশ এক ভাষার মানুষ নিয়ে মুদ্রাবিহীন অবস্থায়; কালক্রমে কেবল মাত্র যোগাযোগ অন্তরায়/বৈরীতার জন্যই বহু দেশ ও বহু ভাষার সৃষ্টি হয়েছে, যোগাযোগ ব্যবস্থার নিরন্তর উন্নতির ফলে আবার ভবিষ্যতে কোন একদিন দেশ ও ভাষার বিভাজন বিহীন পৃথিবী আসবে, কয়েকটি দেশ ও কয়েকটি জীবিত ভাষার পৃথিবী যেখানে ভৌগলিক অবস্থানের ভিত্তিতে কারও নাগরিক অধিকার বিবেচিত বা কারও কোন পার্থক্য নির্নীত হবেনা এবং ভাষাগুলি কম-বেশী সবাই জানবে, তা কত সময় পরে আসবে তা অনিশ্চিত হলেও অদুর ভবিষ্যতেই পৃথিবীতে যাতায়াত এবং যোগাযোগের কোন অন্তরায় থাকবেনা। মানুষ চাইলেই অন্য কোন সমস্যা না থাকলে পৃথিবীর যে কোন স্থানে যেতে এবং অপর যে কোন লোকের সঙ্গে ভাষাগত সীমাবদ্ধতার উর্ধে উঠে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবে, অন্তত উভয়ই কোন না কোন সাধারন ভাষা জানবে, অন্তত তথ্যের আদান-প্রদানে ভাষা কোন বাধা হবেনা।
No comments:
Post a Comment