Sunday, June 5, 2011

বিচারের আইন নাকি আইনের বিচার!


সভ্যতার অন্যতম আশির্বাদ আমাদের বিচার ব্যবস্থা। প্রকৃত পক্ষে এই বিচার ব্যবস্থাই মানুষকে সভ্য হিসাবে গড়ে তুলেছে। যতদূর জানা যায়বিচার ব্যবস্থার জন্য কোন ওহি নাজেল হয়নি বরং মানুষের প্রয়োজনে মানুষের হাতেই এই বিচার ব্যবস্থার জন্ম এবং মানুষের হাতেই তা দিনে দিনে আরও সুসংহত হয়েয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু কাঠামোগত বিচার ব্যবস্থার ইতিহাস খুব বেশী পুরাতন নয়মাত্র হাজার খানেক বছর আগে এর জন্ম। তবে খৃষ্টপূর্ব ৩০০০ অব্দে বিচ্ছিন্ন ভাবে বিচার ব্যবস্থার আলামত পাওয়া যায় যা ছিল নিতান্তই ব্যক্তি কেন্দ্রিক এবং সীমিত এলাকা কেন্দ্রিক। তখনকার বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে বর্তমান বিচার ব্যবস্থার কোনইমি নেই। আমাদের বর্তমান চেহারার বিচার ব্যবস্থার যাত্রা শুরু হয় একাদশ শতকের গোড়ার দিকে আজকের বৃটেনে। ব্রিটিশ বিচার ব্যবস্থার ক্রমবিবর্তন থেকেই আজকের এই সুসংগঠিত বিচার ব্যবস্থার সৃষ্টি। অবশ্য ফ্রান্স ও জার্মানীর অবদানও উল্লেখযোগ্য।
 তখনকার বিচার দর্শন ও বিচার প্রক্রিয়ার সাথে বর্তমান সময়ের বিচার ব্যবস্থার সাথে মিল ছিল খুবই কম। তথাপি বর্তমান কাঠামোগত বিচার ব্যবস্থা গঠনে এর ভুমিকা  ছিল অসামান্য। পরবর্তীতে বিভিন্ন পরিবর্তনসংযোজনবিয়োজনপ্রতিস্থাপনের মাধ্যমে প্রায় হাজার বছরের বিবর্তনের ফসল আমাদের বর্তমান বিচার ব্যবস্থা। সময়ের সাথে সাথে এই বিবর্তনের ধারা অব্যাহত আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। বিচার ব্যবস্থার যাত্রা শুরু হয়েছিল মুলত শাসন কাজের অংশ হিসাবে। বর্তমানে অনেক দেশেই স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকলেও শাসন বিভাগের প্রচ্ছন্ন প্রভাব এতে বিদ্যমান।
 শুরুতে বিচার ব্যবস্থা খুব একটা বৈজ্ঞানিক এবং যুক্তি সংগত ছিলনা। মুলত শাসন কার্য নির্বিঘ্ন করার জন্য শাসক গোষ্ঠী বিচার ব্যবস্থাকে ব্যবহার করেছে। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা ছিল প্রতিশোধ পরায়ণ এবং নৃসংশ। দোষী নির্ধারনের প্রক্রিয়া বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই ছিল অত্যন্ত ভয়ংকর ও স্বেচ্ছাচারী। যেমন আগুনের মধ্যে ঝাপ দিয়ে বা হাত-পা বাধা অবস্থায় পানি থেকে উঠে এসে নিরাপরাধের প্রমান দিতে হতো যা আজকের দিনে ভাবাই যায়না। কালক্রমে বিচার ব্যবস্থা বর্তমান শোভন রূপ ধারন করেছে।
 আধুনিক বিচার ব্যবস্থার বীজ বপন করেন দ্বিতীয় হেনরী। তিনি প্রথম ১৮ জন বিচারক নিয়োগ দেন যাদের ৫ জন শাসন কাজে সহযোগীতা করত ও অন্যরা দেশ ব্যাপি প্রচলিত রীতি নীতির আলোকে বিচার কাজ পরিচালনা করত। এসময়ই সবার জন্য প্রযোজ্য একই ধরনের সধারণ আইনের আওতায় বিচারের প্রথা গড়ে ওঠে। ১২৮৫ সালে প্রথম এডওয়ার্ড ভাল এবং নীতিবানলোকদের সমন্বয়ে ম্যাজিষ্ট্রেট কোর্ট গঠন করেন সামাজিক শান্তি শৃংখলা বজায় রাখার জন্য। যে ধারায় বর্তমানেও আইন শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিচারের অধিকাংশই ম্যাজিষ্ট্রেট কোর্টে সম্পন্ন হয়।
 বিচার ব্যবস্থা সভ্য সমাজের আয়না সরুপ। তাতে যেমন সভ্যতার প্রকৃত রুপ বোঝা যায়তেমনই সভ্যতা গঠনেও বিচার ব্যবস্থা কার্যকর ভুমিকা  রাখে। মানুষের নীতি বোধ বা অপরাধবোধ অনেক খানিই বিচার ব্যবস্থা দ্বারা প্রভাবিত ও পরিচালিত। বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতা মানুষকে অপরাধ প্রবণ করে তুলে। আস্থাশীল বিচার ব্যবস্থা মানুষের মানবিক উৎকর্ষতা উন্নয়নে সহায়ক ভুমিকা  রাখে।
 বিচার ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হচ্ছে আইন যা পূর্ব নির্ধারিত কিছু বিধি-নিষেধ দ্বারা পরিচালিত। এই আইন সাধারণত দুই ধরনের-১.মানুষের প্রমিত আচার আচরণ নির্ধারনের আইন এবং ২. উক্ত আইন বাস্তবায়নের আইন। সধারণ ভাবে আইন বাস্তবায়নের আইন প্রয়োগ করেন বিচারকগন প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত আইনের আলোকে। আর সকল আইন তৈরী করে শাসক গোষ্ঠী। 
বর্তমানে প্রচলিত আইনের সবচেয়ে বড় দূর্বলতা হচ্ছে- বর্তমানে বসে অতীত অভীজ্ঞতার আলোকে আইন তৈরী করা হয় ভবিষ্যত ঘটনার বিচার করার জন্য। কিন্তু মানুষের ভবিষ্যত আচরন এবং অপরাধের ধরন সর্বদাই পরিবর্তনশীল। তাই পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে আইনের ফাক গলে অপরাধীরা অনেক সময়ই পার পেয়ে যায়। আবার আইনের কাছে শািস্ত প্রাপ্ত সবাই অপরাধী নয়। আইন বিচার করে অপরাধের ধরন দেখে তাই পেশাদার অপরাধী এবং ঘটনাক্রমে অপরাধী এই দুই শ্রেণী আইনের দৃষ্টিতে একই। কিন্তু আইনের সত্যিকারে সফলতার জন্য অপরাধ ও অপরাধী উভয়কেই বিচারের ক্ষেত্রে বিবেচনা করা দরকার।  বর্তমান আইন আসলে অন্ধতাই তার চোখে সবাই সমান(!)।
আইনের সঠিক ও কার্যকর সাফল্যের জন্য আইন হওয়া উচিৎ ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে। আইনের কোন স'ীর রূপ গঠন না করে স'ীর রূপরেখার ভিত্তিতে ঘটিত ঘটনার প্রেক্ষিতে বাস্তব সম্মত ভাবে আইনের সমন্বয় দরকার। সবচেয়ে বেশী দরকার প্রচলিত আইনের সময়োপযোগী সংস্কারের স্থায়ী কাঠামো। অনেক আগের আইনে বর্তমান ঘটনার বিচার অবিচারের নামান্তর। কারণ ঐ আইন তৈরীর সময়ের প্রেক্ষাপট আর অপরাধ সংগঠনের সময়ের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ন ভিন্ন। তাই আইনের প্রতি সুবিচারের জন্যই প্রতিনিয়ত আইনের হাল নাগাদ সংস্কার করা দরকার। এজন্য সবার আগে দরকার আইনের নিয়মিত হাল নাগাদ সংস্করনের আইন যা দর্শন অপরিবর্তিত রেখে আইনকে কার্যকরনের জন্য সময়োপযোগী করবে। সংস্কার মানে নিত্য-নতুন এবং কঠোর থেকে থেকে কঠোরতর আইন নয়দরকার ভবিষ্যতমূখী আইনের আইনী কাঠামো।

No comments:

Post a Comment