বর্তমান পৃথিবীতে যে ছয় হাজার আটশ নয়টি ভাষা জীবিত আছে তার অধিকাংশই আদিবাসিদের ভাষা। তুলনামুলক ভাবে আদিভাষি জনসংখ্যা কম হলেও অদিভাষার সংখ্যা অনেক তবে তা আশংকাজনক হারে ক্রমহ্রাসমান। এইধারা অব্যাহত থাকলে অদুর ভবিষ্যতে পৃথিবী থেকে আদিভাষি চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে যার পরিনতিতে আদিভাষাও একদিন হারিয়ে যাবে বা গবেষনাগারে স'ান নিবে। সাধারন অর্থে আদিবাসি বলতে আমরা মুলত বিশেষ গোত্রের মানুষগুলোকে বুঝি যাদের জীবন অনেকটা প্রকৃতি ও নিজেদের লালিত সংস্কারে চালিত এবং তথাকথিত সভ্য জগৎ ও বিজ্ঞান হতে বিচ্ছিন্ন অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠী, যওি তারা আমাদের মতই রক্ত-মাংসের মানুষ। বর্তমানে আদিবাসিরা বর্তমানে যে অবস'ায় আছে ঠিক এই অবস'ায় আমাদের পূর্বপুরুষরাও কোন একদিন ছিল।এখন প্রশ্ন হচ্ছে পৃথিবী থেকে আদিবাসি বা আদিভাষিরা হারিয়ে যেতে থাকলে তার ফলাফল কি হবে,এত কার লাভ, কার ক্ষতি,নাকি এটাই সভ্যতার প্রতি সময়ের সময়োচিত নির্দেশ?কালের বিবর্তনে পৃথিবী থেকে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ভাষা হারিয়ে যাবে এবং তা কোন ক্রমেই রোধ করা যাবেনা, বড়জোর ক্রমহাসমানতার হার কিছুটা হ্রাস করা যেতে পারে, যদিও এনিয়ে বিশ্বে দেন-দরবার কম খুব একটা হচ্ছেনা।
আদিবাসিদের আমরা যে নামেই ডাকিনা কেন তাদের সম্পর্কে আমাদের যে মনছবি তাতে তারা অন্তত আমাদের স্বমগোত্রীয় নয়, তাই তাদের অধিকারও উপেক্ষিত সমাজপতিদের কাছে। তাই বলে তাদের ভাগ্যেন্নয়নের চেষ্টা যে একেবারে নেই তা বলা যায়না, তবে তাতে নতুন কিছু পেশা ও পেশাজীবির সৃষ্টির মাধ্যমে সমাজপতিদের হাতকেই শক্তিশালী করেছে আরও বেশী। সত্যিকার অর্থে আদিবাসিদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য আমাদের আগে একটা মৌলিক বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসতে হবে যে, আমরা কি আদিবাসিদের চিরকাল আদিবাসি বানিয়ে রাখব নাকি আমাদের মত সভ্য রূপে গড়ে উঠতে সহায়তা করে আমাদের সমপর্যায়ে নিয়ে আসব? আমরা যদি জঙ্গল-পাহাড়ের জীবন ছেড়ে এই নাগরীক জীবনে এসে ভুল না করে থাকি তবে যত দ্রুত সম্ভব তাদেরকে আমাদের কাতারে নিয়ে আসতে হবে। কারণ মানুষ হিসাবে অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর অংশকে অগ্রসর অংশের এগিয়ে নেওয়া নৈতিক দায়িত্ব। আবার আমরা যদি ভুল করে থাকি তাহলে তা যত দ্রুত সম্ভব সংশোধন করে আবার ঐ জঙ্গল-পাহাড়ের জীবনে ফিরে যাওয়া উচিৎ আমাদের। আসলে সভ্যতার বিকাশে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অবস'ান নির্ভর করে যে যত আগে পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার উপর। তাই আমাদের জাতি ভাইদের একটা অংশ যদি কোন অংশ যদি কোন কারনে জীবনের দৌড়ে পিছিয়ে পরে তবে অপর অংশ এগিয়ে নেবে এটাইতো হওয়ার কথা সভ্য মানুষের ভব্য আচরন।
আদিবাসিদের সাথে আমাদের মূল পার্থক্য অর্থের মালিকানা সংক্রান্ত, কারণ গড়পড়তায় একজন আদিবাসির জীবনের মোট আয় ও ব্যয় আমাদের চেয়ে কম। আবার গোষ্ঠীগত ভাবেও তারা পৃথিবীর মোট অর্থের উপর থেকে প্রায় কোন হিস্যাই আদায় করতে পারেনি। একারনে তারা এমন জীবনে অভ্যস' থাকতে চায় যেখানে অর্থ প্রয়োজন হয়না বা হলেও তা একবারেই অনুল্লেখযোগ্য, আর এই পার্থক্যই অন্যান্য পার্থক্যের জন্ম দিয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে বসবাসকারী ৪৮টি ক্ষুদ্র জাতি সত্ত্বার প্রায় ২৫লাখ মানুষের জীবন-মান এর উন্নয়নে আন্তর্জাতিক,জাতীয ও স'ানীয় উৎস হতে যে পরিমানে ব্যয় দৃশ্যমান সেতুলনায় তাদের জীবন-মান এর উন্নয়ন দৃশ্যমান নয়। উন্নয়ন ব্যয় যত বাড়ছে, উন্নয়ন নয় উন্নয়ন কর্মী ও উন্নয়ন কর্ম তত বাড়ছে।
বতর্মানে নৃতাত্ত্বিক ভাবে পৃথিবীর আদি বাসিরা যে অবস'ায় আছে , ঠিক এই অবস'ায় আমাদের সকলেরই কোন এক পূর্ব পুরুষ ছিল । তাই কি অর্থে তাদেরকে আদি বাসি বলা হয় তা আমার কাছে পরিষ্কার নয় । তবে একথা সত্য যে পৃথিবীতে আদি বাসির অস্তিত্ব আমাদের মনে সভ্যতার প্রতিরূপ গঠন সহজ করে দিয়েছে । কারণ আমরা সভ্য মানুষ বলতে তাদেরকেই বুঝি যারা আদি বাসি নয়, ফলে আমাদের সভ্যতা বোধ অনেকটাই বিভ্রান্তিকর । মূলত আমাদের সভ্যতাকে সহজে বর্ননাযোগ্য করার জন্য আদি বাসি ধারণাটি খুবই কার্যকর । কেননা আদি বাসিদের সঙ্গে দৃশ্যমান পার্থক্য তুলনা করা ছাড়া বর্তমান সভ্যতার স্পষ্ট বিবরন সহজবোধ্য নয় । আবার পক্ষান্তরে আদি বাসি বলতেও আমাদের মনে এমন এক ধরনের মানুষদের চেহারা ভেসে ওঠে যারা আমাদের অনেক আগের কল্পিত পূর্ব পূরুষদের মত ।
একটা বিষয় আমার কাছে মোটেও পরিস্কার নয় । আর তা হলো পৃথিবীতে আদি বাসিরা চিরকাল থাকবে কিনা । কারণ তারা যদি জৈবিক ভাবে আমাদের মতই হয় তাহলে কোন এক সময়ে স্বাভাবিক নিয়মেই তাদের আমাদের বর্তমান পর্যায়ে আসার কথা, আমরা হয়তো আরও উন্নত হব, কিন্ত তখনও কি তাদের আদি বাসি বলা হবে? আর এই আদি বাসিরা এলো কোথা হতে? তারা কি আমাদের চেয়ে ভীন্নতর কোন মানুষ?
এটা ঠিক যে, আদি বাসিদের জীবনে অর্থের সংশ্লেষ খুবই কম। আদি বাসিরা শুধু কম অর্থের মালিকই না, তারা ব্যক্তিগত এবং গোষ্ঠীগত ভাবে সবচেয়ে কম অর্থের কারবারী।
ঊর্তমান পৃথিবীতে যত জীবিত ভাষা আছে তার অধিকাংশই আদি বাসিদেও আদি ভাষা।তুলনামুলক ভাবে আদি বাসি গোত্রের সদস্য সংখ্যা অন্যান্য ভাষা ভাষি গোত্রের চেয়ে কম।বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষন করলে দেখা যায় যে ক্রমান্বয়ে আদি বাসি ও আদি ভাষির সংখ্যা কমছে।এই ধারা অব্যাহত াকলে ভবিষ্যতে কোন এক দিন পৃবিী থেকে আদি বাসি এবং আদি ভাষি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
No comments:
Post a Comment