সমগ্র বাংলাদেশের শস্য উৎপাদন ব্যবস'ায় যে পরিমান পুঁজি নিয়োজিত আছে তার সিংহভাগই বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে রাষ্ট্রায়ত্ব বাণিজ্যিক ও বিষেশায়িত ব্যাংক গুলোর মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী সরাসরি শস্য উৎপাদন ব্যবস'ার সঙ্গে জড়িত। কিন' দারিদ্র ও আর্থিক অসচ্ছলতার কারনে তারা নিজেরা শস্য উৎপাদনে সঠিক সময়ে পুঁজি বিনিয়োগ করতে পারেনা ফলে তারা দারস' হয় প্রাতিষ্ঠানিক অথবা অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ দাতাদের দরজায়। ব্যাংক সমূহ প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের বৃহত্তম যোগানদাতা। অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণের রাহু গ্রাস সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নাই।
বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে শস্য ঋণ প্রদানের জন্য ‘লীড ব্যাংক’ পদ্ধতি প্রচলিত। প্রতিটি লীড ব্যাংকের শাখা বাধ্যতামুলক ভাবে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নে শস্য ঋণ প্রদান করে। বাংলাদেশে উৎপাদিত প্রায় সকল ফসলেরই উৎপাদনকাল ও উৎপাদন ব্যয় বিবেচনায় এনে বাংলাদেশ ব্যাংক কতৃক নির্দ্দিষ্ট ফসলের জন্য ঋণের পরিমান ও সময় নির্ধারন করা আছে। কৃষকের আবেদনের প্রেক্ষিতে ব্যাংক সমূহ তার চাষাধীন জমির পরিমান ও ফসলের ভিত্তিতে উক্ত নীতিমালার আলোকে ঋণ মন্জুর ও বিতরন করে থাকে। শস্য ঋণ সাধারনত এক কিসি-তে বিতরন ও আদায় করা হয়। ফসল উঠার সময় ঋণ পরিশোধকাল নির্ধারিত হয়।
এই পদ্ধতিতে নির্দ্দিষ্ট ফসল বপনকালে ঐ ফসলের সমুদয় উৎপাদন খরচ এককালীন ঋণ হিসাবে প্রদান করা হয়। এবং ফসল উঠার প্রায় সাথে সাথেই ঋণের টাকা সূদসহ আদায় করা হয়। ঋণ উত্তোলনের পর একবারেই সব অর্থ ব্যয় হয়না, কিন' ঋণের সূদ গুনতে হয় ষোল আনা। আবার বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে ঋণের অর্থ অন্য খাতে ব্যয় হয়ে যায়। ফলে সেচ, সার-কীটনাশক ইত্যাদি কাজে ব্যয় করার জন্য হাতে সময় মত অর্থ থাকেনা এবং উৎপাদন ব্যহত হয়। আবার বপনের সময় বেশী দামে বীজ কিনে ফসল উঠার সাথে সাথে তুলনামুলক কম দামে ফসল বিক্রয় করতে হয় ঋণ পরিশোধের জন্য।অধিকাংশ সময় কৃষকেরা ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া সত্ত্বেও ফসল ওঠার আগমূহুর্তে চড়া সূদে মহাজনদের কাছ থেকে ধার নিতে বাধ্য হয়। ফসল ওঠা মাত্রই মহাজনরা তাদের পাওনা টাকা নিয়ে যায়, ব্যাংকের টাকা অনাদায়ী পড়ে থাকে। আংশিক টাকা ব্যাংকে জমা দিলে আবার তা ওঠানো যাবেনা ফলে পরবর্তী ফসলের সময় আরও বড় সমস্যা হবে ভেবে অনেকেই হাতে টাকা থাকা সত্ত্বেও ব্যাংকের টাকা আংশিক পরিশোধ করেনা। কালক্রমে তা শ্রেনীকৃত তথা কু ঋণে পরিনত হয়। এক সময় সূদে আসলে ঋণের টাকা পরিশোধ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে কৃষকেরা নিজেরাও অর্থনৈতিক ভাবে পঙ্গু হয়ে যায়।
বাংলাদেশের সাধারন কৃষকদের জীবন ধারন সময়ের সাথে সাথে চ্যালেনজিং হয়ে উঠেছে। সরল উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যে কৃষক নিপুন শিল্পি তার অর্থনৈতিক জীবনেও এসেছে বহুমাত্রিকতা। বেশীর ভাগ কৃষক পরিবারের জীবন ধারনের জন্য যথেষ্ট ভূমি নাই। সে জন্য তাকে হতে হয় অতি হিসেবী। যেমন; ফসল উৎপাদনের বীজ সে যথাসম্ভভব নিজের উৎপাদিত ফসল থেকে সংগ্রহ করে, যদি একান-ই সম্ভভব না হয় তবে ঐ নির্দ্দিষ্ট ফসল উঠার সময়ই প্রয়োজনের চেয়ে সাধ্যমত বেশী কিনে রাখার চেষ্টা করে, কারন এ সময় উক্ত ফসলের দাম তুলনামুলক কম থাকে এবং বপনের সময় দাম বেশী থাকে। বপনের সময় অতিরিক্ত বীজ বিক্রি করে অন্যান্য ব্যয় নির্বাহ করে থাকে। আবার সুযোগ পেলে বাজারে যখন যে ফসলের দাম কম থাকে তা কিছুটা কিনে রেখে দাম বাড়লে বিক্রয় করে। অর্জিত মুনাফা তার জীবনকে সহজ করে। এভাবে খুব সাবধানে এবং ধীর গতিতে প্রায় কৃষকই শস্য কেনা-বেচার ব্যবসায় নিয়োজিত। অনেক অঞ্চলে যেটা ‘বান্দাই’ করা হিসেবে পরিচিত। এজন্য প্রায় সকল কৃষকই বহুমাত্রিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে তাদের জীবনের চাকা সচল রাখে।
শস্য ঋনের টাকা আনুষ্ঠানিক ঢঙ্গে বিতরন না করে যদি একজন কৃষকের বাৎসরিক চাহিদা এবং তার ঋণ প্রাপ্তির যোগ্যতার ভিত্তিতে সর্বোচ্চ ঋণ সীমা নির্ধারন করে চলতি/নগদ মূলধন ঋণের ন্যায় ঋন হিসাব সৃষ্টি করা হয় যেখানে ঋণগ্রহীতারা নির্দ্দিষ্ট সময় অন-র সূদ পরিশোধ সাপেক্ষে প্রয়োজন মত লেন-দেন করতে পারবে তাহলে ঋনের টাকার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত হবে।
No comments:
Post a Comment