Sunday, June 5, 2011

ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তির সহজ কলাকৌশল !!!


একটি দেশের সামগ্রীক অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে সে দেশের প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থা। ব্যাংক সমূহ মূলতঃ আমানতকারীদের নিকট হতে তুলনামূলক কম সূদে অর্থ সংগ্রহ করে কিছুটা বেশী সূদে আগ্রহী ও যোগ্য ঋণগ্রহীতাদের মাঝে বিতরন করে থাকে। আমানত অপেক্ষা ঋণের এই অতিরিক্ত সূদ হতে ব্যাংকের যাবতীয় খরচ এবং মুনাফা আসে। তাই ব্যাংক সমূহ যত বেশী ঋণ বিতরন করতে পারবে তার আয়ও তত বেশী বাড়বে, মুনাফাও বাড়বে। আবার দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডও বৃদ্ধি পাবে, দারিদ্র হ্রাস পাবে, সামগ্রীক অর্থনীতিও হবে সমৃদ্ধ ও গতিশীল।
ব্যাংকের প্রায় সমস্ত অর্থই আমানতকারীদের গচ্ছিত। আমানতকারীদের কষ্টার্জিত সঞ্চয়ের সুরক্ষা দেয়া ব্যাংকের অবশ্য কর্তব্য। তাই, ব্যাংক কোন খাতে বিনিয়োগ করার পূর্বে নিশ্চিত হতে চায় যে, বিনিয়োগকৃত অর্থ যথাসময়ে সূদসহ ফেরত আসবে। এজন্য ব্যাংক তার নিজস্ব পদ্ধতিতে কিছু পদ্ধতিগত সতর্কতা অবলম্বন করে থাকে।
অনেকেই বলে থাকেন যে, ব্যাংক ঋণ পাওয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার, ”জানাশোনানা থাকলে এবং উৎকোচ ছাড়া ঋণ পাওয়া দুষ্কর। অভীজ্ঞতায় দেখা যায় যে, জটিলতার কথা ভেবে অনেক সম্ভাবনাময় উদ্যোক্তা ঋণের জন্য ব্যাংকে আসেন না কিম্বা আসলেও নিয়ম কানুনের গ্যাড়াকলে পরে বিদায় হয়। যদিওবা শেষ পর্যন্ত কেউ ঋণ পেয়ে থাকেন তবে তার জুতার তলায় কিছু থাকেনা। প্রকৃতপক্ষে ব্যাংকের ঋণদান পদ্ধতি সম্পর্কে অজ্ঞতাই অধিকাংশ হয়রানীর কারন। ব্যাংকের ঋণদান পদ্ধতী সম্পর্কে কিছুটা ধারনা থাকলে এই দুঃসাধ্য কাজটি হতে পারে অনেক সহজ ও অনায়াসলব্ধ।
আমাদের দেশে অনেক উদ্যোক্তাই আছেন যারা প্রয়োজনীয় পুজির অভাবে নানা ধরনের আয় উৎসারী কর্মকান্ড ও ব্যবসা শুরু করতে পারছেন না। আবার শুরু করলেও তা পরিচালনা বা সমপ্রসারন করতে পারছেন না। অনেকেরই বিভিন্ন আয় উৎসারী কর্মকান্ড সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও দক্ষতা আছে, ইকুইটি (মোট বিনিয়োগকৃত পুজির উদ্যোক্তার বাধ্যতামুলক অংশ) বিনিয়োগের সামর্থও আছে শুধু প্রয়োজনীয় পুজির অভাবে প্রকল্পটি স্থাপন করতে পারছেন না। অনেকেই পারিবারিক ভাবে গবাদী পশু পালন বা কৃষি ও সেচ যন্ত্রপাতি ক্রয় করতে ইচ্ছুক কিন্তু টাকার অভাবে তাহচ্ছেনা। অথচ প্রায় সকল ব্যাংকেই প্রচুর অর্থ অলস পড়ে আছে যোগ্য(!) উদ্যোক্তার অভাবে বিনিয়োগ করতে না পেরে যা ব্যাংকের জন্য রীতিমত বোঝা। অপরদিকে দেশের আপামর জনসাধারনের কষ্টার্জিত সঞ্চয় দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভ'মিকা রাখার সূযোগ হতে বঞ্চিত হচ্ছে। অথচ সঞ্চয়কারীর অর্থ উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে বিনিয়োগ করাই ব্যাংকের অণ্যতম প্রধান লক্ষ্য  এই লক্ষেই দেশের সকল সরকারী/বেসরকারী ব্যাংক সহজ শর্তে ঋণদান করে থাকে।
আগ্রহী ঋণ গ্রহীতাদের বিশেষ করে গ্রামীণ কৃষি ঋণ গ্রহীতাদের দুঃসাধ্য কাজকে কিছুটা হলেও সহজ করতে কিভাবে সহজে ও স্বল্প সময়ে ব্যাংক হতে ঋণ পাওয়া যায় সে ব্যাপারে সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে এই লিফলেটে ।**
ঋণদানের ক্ষেত্রে ব্যাংকের বিবেচ্য বিষয়াবলী ঃ
কোন ঋণ প্রস্তাব বিবেচনা কালে ব্যাংক প্রধানত নিম্নোক্ত বিষয়গুলি বিবেচনা করে থাকে-
১)         উদ্যোক্তা, ২)         উদ্দেশ্য, ৩)           ইকুইটি (প্রযোজ্যক্ষেত্রে) ও ৪)  জামানত (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে)।
উপরোক্ত বিষয়াবলী বিবেচনার ক্ষেত্রে ব্যাংকের দৃষ্টিভঙ্গি জানা প্রয়োজন। কেননা ব্যাংকের দৃষ্টিভঙ্গি জানা থাকলে ঋণ গ্রহীতা তার ঋণ প্রাপ্তির যোগ্যতা সম্পর্কে নিজেই ধারনা করতে পারে।
উদ্যোক্তা নির্বাচন ঃ ব্যাংক সাধারনত সৎ, কর্মক্ষম, উদ্যমি, আর্থিক ভাবে সচ্ছল এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন উদ্যোক্তাকে অগ্রাধীকার দিয়ে থাকে। উদ্যোক্তার আর্থিক চরিত্র এবং এলাকায় সুনাম এবং ইকুইটি বিনিয়োগের সামর্থ বিবেচ্য।
উদ্দেশ্য ঃ            ঋনের উদ্দেশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের অনুমোদিত খাত হতে হবে। সাধারনত স্বল্প মেয়াদী ও মধ্য মেয়াদী ঋণকে ব্যাংক অগ্রাধীকার দিয়ে থাকে। প্রকল্প/ব্যবসার আর্থিক সম্ভাব্যতা যাচাই সাপেক্ষে মোট ব্যায়ের ৫০% হতে ৭০% পর্যন- ঋণ সহায়তা দিয়ে থাকে। অনেক সময় সরকার অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনা করে কোন কোন খাতকে বিশেষ খাত হিসাবে চিহ্নিত করে ঐ খাতে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে নিয়ম কানুন অনেক শিথিল করে থাকে। এ ধরনের খাতে ঋণ পাওয়া তুলনামুলক সহজ।
ইকুইটি ঃ যে কোন প্রকল্প ঋণের ৰেত্রে উদ্যোক্তাকে প্রথমেই মোট প্রকল্প ব্যয়ের কমপক্ষে ৩০% - ৪০% নিজস্ব তহবিল হতে বিনিয়োগ করতে হয়। তাই যে কোন প্রকল্প শুর্বর আগেই এই বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। উলেৱখ্য যে  স্থাবর প্রকল্পের ৰেত্রে  উক্ত প্রকল্পটি সম্পূর্নই জামানত হিসাবে গন্য হয়, এৰেত্রে আলাদা কোন জামানতের প্রয়োজন নেই।
জামানত ঃ সর্বশেষ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন বিষয় হচ্ছে প্রস্তাবিত ঋণের বিপরীতে প্রদত্ত্ব জামানত। অস্থাবর প্রকল্প বা প্রকল্পের পরিচালন ব্যয় ও ব্যবসায়িক ঋণের জন্য জামানত হিসেবে ব্যাংক সহজে নগদায়নযোগ্য সিকুরিটি ডকুমেন্ট (স্থায়ী আমানত, শেয়ার, ডিবেঞ্চার ইত্যাদি) সর্বাপেক্ষা অগ্রাধীকার দিয়ে থাকে। কৃষি ও অকৃষি জমি, দালান-কোঠা ইত্যাদিও জামানত হিসাবে গ্রহনযোগ্য। উদ্যোক্তার জামানত দেবার মত সম্পদ না থাকলে অন্য কেউ তার পক্ষে জামানত প্রদান করতে পারবে।
উপরোক্ত বিষয়াবলীর আলোকে আগ্রহী ঋণ গ্রহীতাকে নিম্নোক্ত কাগজপত্র/তথ্যাদি সংগ্রহ ও প্রয়োজনীয় প্রস'তি সম্পন্ন করতে হবে ঃ-
সকল ঋণের ক্ষেত্রে (শস্য ঋনের  ক্ষেত্র ব্যতিত)।-
ক)         প্রাথমিক প্রস্তুতি
১।         প্রথমেই আপনি কি করতে চান তা নির্ধারন করুন (অবশ্যই সে বিষয়ে আপনার প্রয়োজনীয় অভীজ্ঞতা/জ্ঞান থাকতে হবে) এবং সে সম্পর্কে হাল নাগাদ প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করুন।
২।         প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রকল্পের/ব্যবসার সম্ভাব্যতা যাচাই সাপেক্ষে উপযুক্ত স্থান নির্ধারন করুন।
৩।         প্রকল্পের/ব্যবসার মোট ব্যায় নির্ধারন করুন।
৪।         মোট ব্যায়ের কমপক্ষে ৩০% - ৪০% নিজস্ব তহবিল হতে বিনিয়োগ করার সংস্থান করুন।
খ)         প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
১।         সদ্য তোলা ২ (দুই) কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি।
২।         নাগরিকত্বের সার্টিফিকেট।
৩।         হাল নাগাদ চৌকিদারী ট্যাক্সের রশিদ।
৪।         ব্যাংক ঋণে প্রদত্ত অর্থের বিপরীতে প্রস্তাবিত জামানত জমি হলে ঃ-
ক)         উদ্যোক্তার নামে আরএস রেকর্ডের ভিত্তিতে নামজারী খতিয়ান,
খ)         হাল সনের খাজনার দাখিলা,
গ)         সংশ্লিষ্ট এসএ এবং আরএস খতিয়ানের মূল/সার্টিফাইড কপি,
ঘ)         ওয়ারিশ সূত্রে মালিক হলে ওয়ারিশান সনদ এবং বন্টননামা,
ঙ)         ক্রয় সূত্রে মালিক হলে মূল দলিল এবং ভায়া দলিল সমূহ (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে),
এছাড়াও ঋণের খাত বিশেষে কিছু বিশেষ নিয়ম কানুন আছে যথা ঃ-
ক)         নতুন প্রকল্প ঋণের ক্ষেত্রে ঃ-
১।         প্রকল্পের লে-আউট প্ল্যান,
২।         প্রকল্পের আর্থিক বিশ্লেষনসহ বিস-ারিত প্রোফাইল,
৩।         প্রকল্প স্থাপনের ব্যাপারে উদ্যোক্তার প্রশিক্ষন/অভীজ্ঞতার সনদ,
৪।         স্থানীয় কতৃপক্ষের অনাপত্তি সার্টিফিকেট,
৫।         প্রযোজ্য লাইসেন্স (হাল নাগাদ),
৬।         উপযুক্ত স্থানে প্রয়োজনীয় প্রকল্প ভূমি।
এছাড়াও র্বগ্ন প্রকল্প পুনরায় চালু বা চালু প্রকল্প সমপ্রসারনের ক্ষেত্রেও ব্যাংক উপযুক্ততা বিবেচনা করে ঋণ দিয়ে থাকে।
খ)         প্রকল্পে/ব্যবসায় চলতি/নগদ মূলধন ঋণের ক্ষেত্রে ঃ
১।         সংশ্লিষ্ট ব্যাংক শাখায় একটি চলতি হিসাব থাকতে হবে যাতে সনেতাষজনক ভাবে লেন-দেন করতে হবে।
২।         ব্যবসায়িক কর্মকান্ডের স্বপক্ষে দালিলিক প্রমান।
৩।         নিজস্ব অথবা কমপক্ষে ৩(তিন) বছরের চুক্তিতে ভাড়াকৃত দোকান/গোডাউন ঘড়।
৪।         ট্রেড লাইসেন্স।
গ)         বাড়িতে গাভী পালনের ক্ষেত্রে ঃ-
১।         নিজ বাড়িতে বন্যা মুক্ত স্থানে গাভী রাখার স্থান/ঘড় থাকতে হবে।
২।         বাড়ির আশে পাশে চারন ভূমি বা বিকল্প খাবারের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
৩।         ঋণের টাকা আবৃত করতে প্রয়োজনীয় সহায়ক জামানত।
ঘ)         হালের বলদ ক্রয়ের ক্ষেত্রে ঃ-
১।         প্রকৃত কৃষক হতে হবে।
২।         নিজস্ব চাষযোগ্য কৃষি জমি থাকতে হবে।
৩।         নিজ বাড়িতে বন্যা মুক্ত স্থানে গরু রাখার স্থান/ঘড় থাকতে হবে।
৪।         ঋণের টাকা আবৃত করতে প্রয়োজনীয় সহায়ক জামানত।
ঙ)         কৃষিযন্ত্রের ক্ষেত্রে ঃ-
১।         প্রকৃত কৃষক হতে হবে।
২।         সেচ যন্ত্রপাতি/পাওয়ারটিলার/ট্রাক্টর ইত্যাদির ক্রয় মূল্যের ১০%-২০% ডাউন পেমেন্ট প্রদানে সক্ষম হতে হবে।
৩।         ঋণের টাকা আবৃত করতে প্রয়োজনীয় সহায়ক জামানত।
চ)         মৎস চাষের ক্ষেত্রে ঃ-
১।         নিজস্ব পুকুর থাকতে হবে অথবা,
২।         নিজস্ব পুকুর না থাকলে কমপক্ষে ৩ (তিন) বছরের লিজকৃত হতে হবে।
৩।         ঋণের টাকা আবৃত করতে প্রয়োজনীয় সহায়ক জামানত হিসাবে পুকুর বা অন্যান্য জমি।
ছ)    শস্য ঋণের ক্ষেত্রে ঃ-
১।         আবেদনকারীকে প্রকৃত কৃষক হতে হবে।
২।         নিজস্ব বা ভাড়া/লিজ/বর্গাকৃত চাষযোগ্য কৃষি জমি।
৩।         প্রযোজ্য ৰেত্রে সহায়ক জামানত (প্রায় সকল ফসলের ৰেত্রেই ২.৫০ একর পর্যন্ত কোন জামানতের প্রয়োজন নেই)। উল্লেখ্য যে প্রচলিত সকল ফসল চাষের জন্য একর প্রতি প্রয়োজনীয় খরচ বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক আগে থেকেই নির্ধারন করা থাকে।
৪।         চাষাধীন জমির মালিকানার সপক্ষে প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে জামানত/সহায়ক জামানত।
৫।         ভাড়া/লিজ/বর্গাকৃত জমি হলে মালিকের সম্মতি/নিশ্চয়তা পত্র।
শেষ কথা
সর্বপরি আপনাকে ব্যাংক কতৃপক্ষকে আশ্বস্ত করতে হবে যে, ঋণের টাকা সঠিক খাতে ব্যাবহার হবে এবং তা সূদ সমেত সময় মত ফেরত দেয়ার অভিপ্রায় ও সামর্থ আপনার আছে। অনেকেই আসল উদ্দেশ্য গোপন রেখে ব্যবসা বা অন্য কোন কারন দেখিয়ে ঋণ নেয়ার চেষ্টা করে। এটা কখনোই করা উচিৎ নয়। কারন আজকাল ব্যাংক সমুহ প্রয়োজনীয় প্রায় সকল খাতেই ঋণ বিতরন করে থাকে, তাই অযথা ঋণের টাকা অন্য খাতে ব্যবহারের চেষ্টা করার দরকার নেই। কোন নতুন প্রকল্প স্থাপন করতে চাইলে মোট প্রকল্প ব্যায়ের ৫০% ইকুইটি ব্যায় হিসাব করে কাজে নামা ভাল। কারন, বাস্তবে প্রকল্প ব্যায় অনুমিত ব্যায়ের চেয়ে প্রায় সর্বদাই কিছু বেশী হয়ে থাকে। তাতে ব্যাংক ৬০% ঋণ মন্‌জুর করলেও কোন সমস্যা হবে না।

No comments:

Post a Comment