বিশ্ব বাজারে তেলের মূল্য বৃদ্ধি ও এর প্রভাবের ব্যাপারে বর্তমানের বাস-ব চিত্র এবং ভবিষ্যতের সম্ভাব্য চিত্রকল্প রীতিমত আতংক জাগানিয়া। জাতীয় ও আন-র্জাতিক প্রেক্ষাপটে তাই সমস্যাটির গুরুত্ব অপরিসীম। এই সমস্যায় সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস' যারা স্বল্প আয়ের দেশ তাদের এই সমস্যা সমাধানে যথার্থ ভাবে তেমন কিছু করার নেই। তাই এ সমস্যা সমাধানে তেল রপ্তানীকারক দেশ এবং শিল্পোন্নত দেশ সমুহের ইতিবাচক ভ'মিকা বিশ্ববাসীর জন্য নতুন আশার সুবাতাস বয়ে আনতে পারে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তেলের সঙ্গে যৌক্তিক ভাবেই খাদ্যের প্রসঙ্গটি আসে, কারণ তেল নিয়ে তেলেসমাতি আর চাল নিয়ে চালবাজি এখানে নিত্য দিনের ঘটনা।
তেলের মূল্য বৃদ্ধি কোন ঐশ্বরিক ব্যাপার নয়, গুটি কতক দেশ বা গ্রুপের কাছে এর নিয়ন্ত্রন এবং কৌশলগত কারনেই এই মূল্য বৃদ্ধি। তেলের মূল্য বৃদ্ধির ফলে তেল রপ্তানী কারক দেশের লাভ হয় আর শক্তিশালী আর্থিক সামর্থের কারনে শিল্পোন্নত দেশ সমূহ তা মোকাবেলা করতেও পারে। কিন' স্বল্প আয়ের দেশ যাদের এক খাতের ব্যয় বাড়াতে গেলে অন্য খাতের ব্যয় কমাতে হয় তারাই এর ভ'ক্তভোগী। তাই এই সমস্যা সমাধানে তাদেরকেই আগে এগিয়ে আসতে হবে, নিজের সমস্যা অন্যেরা সমাধান করে দেবেনা। এজন্য স্বল্প আয়ের তেল আমদানীকারক দেশ সমূহ একত্রে বা কৌশলগত ভাবে তেল রপ্তানীকারক দেশ সমূহকে তুলনামুলক কম মূল্যে তাদের কাছে তেল বিক্রি করতে রাজি করাতে হবে, এক্ষেত্রে তাদের প্রধান পুজি জনশক্তিকে দর কষাকষির হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে, কারণ খনি থেকে উৎপাদিত তেল বাজারজাত পর্যন- কষ্টকর শ্রমের বেশীর ভাগই এই দরিদ্র দেশের শ্রমিকদের । শিল্পোন্নত দেশ সমূহ যদি তুলনামুলক বেশী দামে তেল কিনতে বাধ্য হয় তাহলে তারা তেলের বিকল্প উদ্ভাবনে আরও বেশী মনোযোগী হবে, আর এ ক্ষেত্রে তাদের অগ্রগামী প্রযুক্তি ও আর্থিক সামর্থ সহায়ক হবে যার লাভ সবাই ভোগ করবে। রেশনিং ব্যবস'ায় এই সমস্যার কোন দীর্ঘ মেয়াদী সমাধান হবেনা কারণ প্রসাশনিক ব্যয় যুক্ত হওয়ায় তা তেল ব্যবহার জনিত মোট ব্যয়কেই বাড়িয়ে দেবে। বরং বর্তমান ব্যবস'ায় তেলের সর্বোচ্চ বিকল্প ব্যবহার নিশ্চিত করা সহ এক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত বাধা উত্তোরনে কাজ করতে হবে, কারণ পৃথিবীতে তেলের মজুদ যাই হোক না কেন তার নিশ্চয় একটা সীমা আছে। কৃষি উৎপাদন বাড়ানো গেলে জৈব জ্বালানী হতে পারে এর ধন্বনতরী সমাধান।
পেটের দায়ে বাংলাদেশের কৃষকের সাথে আমার অনেক দিনের কর্ম নিবাস। তাছাড়া জেনেটিক্যালি স্বগোত্রীয় হওয়ায় তাদের জীবন আমার কাছে নতুন নয়, যা নতুন তা হচ্ছে ভিন্ন অবস'ানের কারনে তাদের জীবনকে ভিন্ন আলোয় দেখা। সমপ্রতি দেশে মাত্র বিশ-পচিশ লাখ টন খাদ্য ঘাটতির আশংকা দেখা দিলে সবার মাথা খারাপ হবার যোগার হয়েছিল, কিন' বছরের পর বছর কোটি কোটি টন খাদ্য ও অন্যান্য শস্য সরবরাহ করছে এই কৃষকেরা প্রায় কোন রকম সহযোগীতা ছাড়াই, এর আর্থিক মূল্য অচিন-নীয়। যদি এক বছর বাংলার কৃষকেরা কোন আবাদ না করে তাহলে যে খাদ্যের দরকার হবে তা মেটানোর ক্ষমতা কি কারও আছে? অথচ নীতি নির্ধারন থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ে কৃষি ও কৃষকের যা গুরুত্ত্ব পাওয়া উচিৎ ছিল তার কিছু মাত্রও পায়নি। যার ফলে বাংলাদেশের কৃষি এখনো প্রায় সম্পূর্নই কায়িক শ্রম নির্ভর, অথচ সামান্য কিছু প্রযুক্তির ব্যবহারে এই শ্রম অর্ধেকেরও বেশী লাঘব করা যায়। কৃষকের জীবন ঘনিষ্ঠ থাকার ফলে তাদের দক্ষতা, সূযোগ, দূর্বলতা ও প্রতিবন্ধকতা খুব কাছে থেকে দেখে আমার মনে হয়েছে এই কৃষক কুলের তথা সমগ্র দেশের ভাগ্য বদল তেমন কোন কঠিন কাজ না। বাংলাদেশে যে নীতি মালা প্রচলিত আছে এবং বাজেটে যে বরাদ্দ আছে তার সামান্য কিছু রদ-বদল/সমন্বয়েই এটা সম্ভব। কারণ ইতোমধ্যে তারা প্রমান করেছে তাদের কাছে বণ্যা-খড়া-মঙ্গা বা ঘুর্নিঝড়তো নস্যিমাত্র, সিডরও কোন ‘ব্যাপারই না’।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জ্বালানী তেলের সাথে খাদ্য সমস্যা অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত, কারণ কৃষি উৎপাদন ব্যয় ছাড়াও জীবনযাত্রার নানা ক্ষেত্রে এর প্রভাব বিদ্যমান যা অন্যান্য স্বল্প আয়ের দেশের জন্যও প্রযোজ্য। কিন' বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সার বিতরন ব্যবস'ার দৈন্যতা প্রমানিত সত্য। তাই ভ'র্তুকী বা রেশনিং ব্যবস'ায় সরকারের প্রসাশনিক ব্যয় ও কৃষকের ভোগানি- জনিত ব্যয় সার ব্যবহার জনিত মোট ব্যয়কে অদৃশ্য ভাবে বাড়িয়ে দেয়। তেলের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সার বা তেলের ভ'র্তূকি তুলে নিলে কৃষকের উৎপাদন খরচ চালের হিসাবে কেজী প্রতি ৩ থেকে ৫ টাকা বৃদ্ধি পেতে পারে তাতে সন্দেহ নাই কিন' উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে পারলে সমস্যা থাকে শুধু নিয়োজিত পুজির। কারণ বেশী পুজি বিনিয়োগ করে উৎপাদিত ফসল বেশী দামে বিক্রয় করতে পারলেই কৃষকের মুনাফা নিশ্চিত হবে। কিন' আমরা কোন দৃশ্যমান ও যৌক্তিক কারণ ছাড়াই হর হামেশাই কেজীতে ৫ থেকে ১০ টাকা বেশী দাম দিয়ে চাল কিনতে বাধ্য হই কোন প্রতিবাদ ছাড়াই। দান-খয়রাতি সাহায্য দিয়ে এ সমস্যার দীর্ঘ মেয়াদী সমাধান হবেনা, প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। বাংলাদেশের অর্থনীতির নায়ক যে দরিদ্র কৃষক কুল তাদের আর্থিক ও অর্থনৈতিক জীবন খুব কাছে থেকে দেখার ফলে আমার মনে হয়েছে যে, তাদের পুজির দরকার আছে কিন' যত দরিদ্র তাদেরকে ভাবা হয় আসলে তারা তত দরিদ্র নয়। আমরা অতি সমপ্রতি লক্ষ্য করেছি মাত্র ২০/২৫ লাখ টন খাদ্য আমদানীর আশংকাতেই সংশ্লিষ্ট সবার ত্রাহি ত্রাহি অবস'া। আর বাংলাদেশের কৃষকেরা প্রত্যেক বছর প্রায় ৩ কোটি টন এর অধিক ফসল দেশকে দেয় প্রায় কোন রকম সহযোগীতা বা প্রতিদান ছাড়াই। এই বিশাল উৎপাদন ব্যবস'ায় যে মহা বিশাল পুজি জড়িত তার অতি ক্ষুদ্র অংশই প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে সরবরাহকৃত, প্রায় পুরোটাই কৃষকের প্রচেষ্টায় সংগৃহীত আর মোট পুজির তুলনায় প্রদত্ত ভ'র্তুকীতো নস্যি মাত্র। বর্তমানে দেশের যে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ কাঠামো তা থেকে প্রকৃত কৃষকেরা প্রায় কোন সুবিধাই পায়না, যা পায় তাও সময়মত পায়না। কৃষি উৎপাদনে জড়িত কৃষকের আর্থিক প্রয়োজন কেবল চাষাবাদের মৌসুমেই নয়, বরং সারা বছরই তার বিভিন্ন পরিমানে আর্থিক প্রয়োজন দেখা দেয়। বাস-বতার আলোকে প্রচলিত ব্যবস'ার বাইরে কৃষি উৎপাদনের জন্য একটি প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ কাঠামো দরকার যা সত্যিকার অর্থেই কৃষকের জন্য উপকারী এবং লাভজনক হবে, যা হতে পারে বাণিজ্যিক চলতিমুলধন/নগদ ঋণের আদলে গৃহস'ালী ঋণ বা অন্য কিছু।
বর্তমান ব্যবস'ায় কৃষকের আবেদনের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার আলোকে ব্যাংক সমূহ তার চাষাধীন জমির পরিমান ও ফসলের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ঋণ মন্জুর ও বিতরন করে থাকে। শস্য ঋণ সাধারনত এক কিসি-তে ফসল চাষের সময় বিতরন ও উঠার সময় আদায় করা হয়। এই পদ্ধতিতে নির্দ্দিষ্ট ফসল বপনকালে ঐ ফসলের সমুদয় উৎপাদন খরচ এককালীন ঋণ হিসাবে প্রদান করা হয়। এবং ফসল উঠার প্রায় সাথে সাথেই ঋণের টাকা সূদসহ আদায় করা হয়। ঋণ উত্তোলনের পর একবারেই সব অর্থ ব্যয় হয়না, কিন' ঋণের সূদ গুনতে হয় ষোল আনা সারা বছর। আবার বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে ঋণের অর্থ অন্য খাতে ব্যয় হয়ে যায়। ফলে সেচ, সার-কীটনাশক ইত্যাদি কাজে ব্যয় করার জন্য হাতে সময় মত অর্থ থাকেনা এবং উৎপাদন ব্যহত হয়। অধিকাংশ সময় কৃষকেরা ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া সত্ত্বেও ফসল ওঠার আগমূহুর্তে চড়া সূদে মহাজনদের কাছ থেকে ধার নিতে বাধ্য হয়। আবার বপনের সময় বেশী দামে বীজ কিনে ফসল উঠার সাথে সাথে তুলনামুলক কম দামে ফসল বিক্রয় করতে হয় ঋণ পরিশোধের জন্য। ফসল ওঠা মাত্রই মহাজনরা তাদের পাওনা টাকা নিয়ে যায়, ব্যাংকের টাকা অনাদায়ী পড়ে থাকে। আংশিক টাকা ব্যাংকে জমা দিলে আবার তা ওঠানো যাবেনা ফলে পরবর্তী ফসলের সময় আরও বড় সমস্যা হবে ভেবে অনেকেই হাতে কিছু টাকা থাকা সত্ত্বেও ব্যাংকের টাকা আংশিক পরিশোধ করেনা। কালক্রমে তা শ্রেনীকৃত তথা কু ঋণে পরিনত হয়। এক সময় সূদে আসলে ঋণের টাকা পরিশোধ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে কৃষকেরা নিজেরাও অর্থনৈতিক ভাবে পঙ্গু হয়ে যায়। প্রকৃত পক্ষে একজন কৃষককে প্রচলিত নিয়মে নিয়মিত ঋণ নেয়া-দেয়া করতে হলে তার উৎপাদিত ফসল বেচতে হবে সংশ্লিষ্ট ফসলের জীবনচক্রে সর্ব নিম্ন দামের সময়, আর প্রয়োজনীয় ফসল বা বীজ কিনতে হবে সর্বোচ্চ দামের সময়।
বাংলাদেশের সাধারন কৃষকদের জীবন ধারন সময়ের সাথে সাথে চ্যালেনজিং হয়ে উঠেছে। সরল উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যে কৃষক নিপুন শিল্পি তার অর্থনৈতিক জীবনেও এসেছে বহুমাত্রিকতা। বেশীর ভাগ কৃষকপরিবারের জীবন ধারনের জন্য যথেষ্ট ভূমি নাই। সে জন্য তাকে হতে হয় অতি হিসেবী। যেমন; ফসল উৎপাদনের বীজ সে যথাসম্ভভব নিজের উৎপাদিত ফসল থেকে সংগ্রহ করে, যদি একান-ই সম্ভভব না হয় তবে ঐ নির্দ্দিষ্ট ফসল উঠার সময়ই প্রয়োজনের চেয়ে সাধ্যমত বেশী কিনে রাখার চেষ্টা করে, কারন এ সময় উক্ত ফসলের দাম তুলনামুলক কম থাকে এবং বপনের সময় দাম বেশী থাকে। বপনের সময় অতিরিক্ত বীজ বিক্রি করে অন্যান্য ব্যয় নির্বাহ করে থাকে। আবার সুযোগ পেলে বাজারে যখন যে ফসলের দাম কম থাকে তা কিছুটা কিনে রেখে দাম বাড়লে বিক্রয় করে। অর্জিত মুনাফা তার জীবনকে সহজ করে। এভাবে খুব সাবধানে এবং ধীর গতিতে প্রায় কৃষকই শস্য কেনা-বেচার ব্যবসায় নিয়োজিত। অনেক অঞ্চলে যেটা ‘বান্দাই’ হিসেবে পরিচিত। এছাড়াও বছরের বিভিন্ন সময় সাময়িক ভাবে বিভিন্ন আয় উৎসারী কর্মকান্ডে নিয়োজিত থাকে। প্রায় সকল কৃষকই বহুমাত্রিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে তাদের জীবনের চাকা সচল রাখে, এখন আর কেউ কেবলমাত্র কৃষক বা কৃষি শ্রমিক নয়। শস্য ঋনের টাকা আনুষ্ঠানিক ঢঙ্গে বিতরন না করে যদি একজন কৃষকের বাৎসরিক চাহিদা এবং তার ঋণ প্রাপ্তির যোগ্যতার ভিত্তিতে সর্বোচ্চ ঋণ সীমা নির্ধারন করে চলতি/নগদ মূলধন ঋণের ন্যায় ঋন হিসাব সৃষ্টি করা হয় যেখানে ঋণগ্রহীতারা নির্দ্দিষ্ট সময় অন-র সূদ পরিশোধ সাপেক্ষে প্রয়োজন মত লেন-দেন করতে পারবে তাহলে ঋনের টাকার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত হবে যার ফলে সার্বিক উৎপাদনশীলতাও বৃদ্ধি পাবে এবং ঋণ ব্যবহার জনিত ব্যয় হ্রাস পাবে কিন' ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে।
খাদ্য রেশনিং কোন ভাবেই কাম্য নয়, অন-ত পরিমানেতো নয়ই। এটা ঠিক যে বাংলাদেশ খাদ্যে সয়ংসম্পূর্ন নয়, আভ্যন-রীন ভাবে প্রয়োজনের চেয়ে কিছু কম খাদ্য শস্য উৎপাদিত হয়। তবে এ ঘাটতি পুশিয়ে দেয় ঐ দরিদ্র কৃষকেরাই বছরের খানিকটা সময় (মঙ্গা,বন্যা,খড়া ইত্যাদি দূর্যোগকালে) একবেলা/দুবেলা না খেয়ে বা কম খেয়ে। এক্ষেত্রে রেশনিং তাদের জন্য মরার ওপর খাড়ার ঘা এর মত হবে। বরং এজন্য উৎপাদন বৃদ্ধিই একমাত্র সমাধান। আমার বিশ্বাস পরিকল্পিতও সমন্বিত উৎপাদন ব্যবস'ায় বাংলাদেশের শস্য উৎপাদন বর্তমানের চেয়ে শতকরা ২০-৫০ ভাগ বৃদ্ধি করা সম্ভব অনায়াসেই। এখনো প্রতি বছর বিপুল পরিমানে শস্য উৎপাদনযোগ্য সরকারী-বেসরকারী জমি অনাবাদী পড়ে থাকে। আবার যেগুলিতে চাষ করা হয় তার ফসল নির্বাচনও খুব একটা যৌক্তিক ও সর্বোচ্চ লাভজনক নয়; সময়োপযোগী তথ্য, প্রযুক্তি ও উপকরনের অভাবে। সরকারের এক ঘোষনায় এক বছরের মধ্যে দেশের চাহিদা মিটিয়েও আভ্যন-রিন মোট উৎপাদিত খাদ্য শস্যের শতকরা প্রায় তিরিশ ভাগ বিশ্ব বাজারে রপ্তানির জন্য খাদ্য আমদানী কারক বিভিন্ন দেশে রোড শো এবং নৈশ ভোজের আয়োজন করার সূযোগ এন দিতে পারে কর্তাদের। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ভয়াবহ সিডরে পাকা ধানে মই দিয়ে গেলে দেশে সাময়িক খাদ্য সংকটের আশংকায় কৃষি কর্তা ও এর পরম্পরায় কর্তা/মহাকর্তারা ঘোষনা দিয়েছিলেন “দেশে এক ইঞ্চি আবাদী জমিও পতিত থাকবে না”। কিন' কে, কোথায়, কেমনে আবাদ করবে নাকি আবাদ করার জন্য কোন দেব দুতের আগমন ঘটবে তা কেউই স্পষ্ট করেননি। কিন' আমার কাছে যা স্পষ্ট তা হচ্ছে-রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক গুলিকে শস্য ঋণ প্রদানে নীতি সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশে আবাদযোগ্য প্রায় সকল ফসলের একর প্রতি উৎপাদন খরচ এবং ফসল ভিত্তিক জমির মৌসুমি ভাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারন করাই থাকে, সেটাকে আরও বিজ্ঞান সম্মত করা যেতে পারে, সেই সাথে দরকার ছোট-খাট কিছু আইনী পরিবর্তন ও সমন্বয়। যেমন, কেউ তার নিজের জমি তিন মাসের বেশী ফেলে রাখতে পারবেনা, রাখলে ঐ জমিতে স্বল্পতম সময়ে উৎপাদিত ফসলের জন্য মৌসুমী ভাড়ার সমপরিমান জরিমানা দিতে হবে। তবে সে নিজে অন্য কাউকে ভাড়া দিতে অক্ষম হলে কৃষি কর্মীকে জানালেই তার দায়িত্ব শেষ। চাষীরা হয় নিজেরাই অথবা কৃষি কর্মীর মাধ্যমে (সমবায় পদ্ধতি বা কৃষি সমপ্রসারন বিভাগের তত্ত্বাবধানে) সহজেই জমি চাষের জন্য ভাড়া নিতে পারবে, একই জমিতে একাধিক চাষী আগ্রহী হলে নিজেদের মধ্যে লটারী করে নেবে। এছাড়া আবাদযোগ্য সরকারী জমি একই ভাবে ফসল ভিত্তিক ভাড়া নেয়ার ব্যবস'া থাকবে, অধিগ্রহণকৃত জমিতেও কাজ শুরুর আগে স্বল্পকালনি সব্জি চাষ করা যেতে পারে। সরকারী লোকদের পরিবারসহ প্রায় অর্ধ কোটি সদস্যারা শুধু খায়, বেশী খায়, কখনো কম খায়না, কিন' খাদ্য শস্য উৎপাদনে যে মহান কৃষকের অবদান, খাবার কম পড়লে তারাই নিজেরা কম খেয়ে, কখনো না খেয়ে এই ঘাটতির সমন্বয় করে। তাই তারা এই মহা নায়কদের বিভিন্ন স্বাস'কর ফল খাওয়ার ব্যবস'া করতে পারে, তারা তাদের অফিস-আদালত, সরকারী আবাসন সহ যত অব্যবহৃত খালি জায়গা আছে সেগুলির কোন স'ায়ী পরিবর্তন না করে , যেগুলি বিশেষ কারণে সীমাবদ্ধ তা ছাড়া সমপূর্ণ টাই স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী বিভিন্ন কম ব্যপ্তি সম্পন্ন ফলের গাছে পূর্ন করে দিতে পারে। উৎপাদিত ফল কে পেল আর কে খেল সেটা বড় নয়, বড় কথা হল দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধিতো হলো। খুব সহজেই হতে পারে বাংলাদেশের সবচেয়ে কম খরচের পানীয় খাঁটি ফলের রস, আর কেনা জানে রসের প্রতি রসনার আসক্তি।
বাংলাদেশের কৃষকেরা যে পরিমান ফসল উৎপাদনের জন্য যে পরিমান কায়িক শ্রম ব্যয় করেন তা পৃথিবীর অন্য কোন দেশের কৃষক করেনা বলেই আমার ধারণা। যদিও আমি অন্য কোন দেশের কৃষক দেখিনি তবে আমার বিশ্বাস বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস'ায় যন্ত্রের ব্যবহার সম্ভবত পৃথিবীতে সবচেয়ে কম বা তার কাছাকাছি। তাই নীতিগত ভাবে বাংলাদেশের কৃষকদের উৎপাদিত ফসলের মূল্য অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশী হওয়া উচিৎ, কারণ বর্তমানে খুব সামান্য বিনিয়োগেই কৃষি জমি চাষ থেকে শুরু করে ফষল কর্তন পর্যন্ত প্রায় সব কাজই যান্ত্রিক উপায়ে করা যায়। অথচ বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা মুলত কৃষকের কায়িক শ্রম নির্ভর যা খুব সহজেই যান্ত্রিক উপায়ে প্রতিস্থাপনযোগ্য এবং তাতে ফসল উৎপাদনের প্রকৃত খরচও হ্রাস পাবে বহুলাংশে, আবার কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে অবমুক্ত শ্রম শক্তির সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার সার্বিক ভাবে দেশজ উৎপাদন বাড়াবে ও মানুষের জীবন-মান এর উন্নয়ন ঘটাবে। রাষ্ট্র ব্যবস্থা কোন রকমে দরিদ্র কৃষকদের বাচিয়ে রেখেছে প্রায় বিনা পয়সায় কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রাখার জন্য। অথচ সার ও তেলে যদি কোন ভ'র্তুকী না দিয়েও সম পরিমান অর্থ কৃষি যন্ত্র-প্রযুক্তি-উপকরন খাতে বরাদ্দ দেয়া হয় তাহলে অচিরেই বাংলায় কৃষি বিপ্লব ঘটতে বাধ্য। কারণ সরকার যদি প্রতিটি গ্রামে সমবায়ের বা অন্য কোন ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে একটি করে কলের লাঙ্গল দিতে চায় তবে তা মাত্র পাঁচ হাজার কোটি টাকা খরচেই সম্ভব যা চলতি বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা ও ক্ষমতায়ন খাতে যা বরাদ্দ আছে (প্রায় ১৮ হাজর কোটি টাকা) তার এক তৃতীয়াংশেরও কম। অথচ বৃহত্তর স্বার্থে কৃষি উৎপাদনে বিনিয়োগই সর্বাধিক লাভজনক এবং কৃষিতে যত বেশী যন্ত্র ও প্রযুক্তির ব্যবহার হবে তা তত বেশী লাভজনক হবে এবং কৃষিতে যন্ত্রায়নই কৃষি বিপ্লবের কামানের গোলা।
বর্তমানের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্বকে নিয়ে এসেছে হাতের মুঠোয়, আর বাংলাদেশ ভৌগলিকভাবে খুবই ছোট্র একটি দেশ। প্রতিটি গ্রামকে উন্নয়নের একক (সমবায় বা অন্য কোন আদলে) ধরে একটি জীবন্ত নেটওয়ার্কের আওতায় আনা যায় সহজেই। কারণ লাখ খানেক এককের নেটওয়ার্ক নজরদারী করা সম্ভব সার্বক্ষনিক ও কেন্দ্রীয় ভাবে। এজন্য নতুন বা বিশাল ব্যয়বহুল কোন প্রযুক্তির প্রয়োজন নেই আদৌ। কেবল প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা ও উদ্যোগ।
তেলের মূল্য বৃদ্ধি কোন ঐশ্বরিক ব্যাপার নয়, গুটি কতক দেশ বা গ্রুপের কাছে এর নিয়ন্ত্রন এবং কৌশলগত কারনেই এই মূল্য বৃদ্ধি। তেলের মূল্য বৃদ্ধির ফলে তেল রপ্তানী কারক দেশের লাভ হয় আর শক্তিশালী আর্থিক সামর্থের কারনে শিল্পোন্নত দেশ সমূহ তা মোকাবেলা করতেও পারে। কিন' স্বল্প আয়ের দেশ যাদের এক খাতের ব্যয় বাড়াতে গেলে অন্য খাতের ব্যয় কমাতে হয় তারাই এর ভ'ক্তভোগী। তাই এই সমস্যা সমাধানে তাদেরকেই আগে এগিয়ে আসতে হবে, নিজের সমস্যা অন্যেরা সমাধান করে দেবেনা। এজন্য স্বল্প আয়ের তেল আমদানীকারক দেশ সমূহ একত্রে বা কৌশলগত ভাবে তেল রপ্তানীকারক দেশ সমূহকে তুলনামুলক কম মূল্যে তাদের কাছে তেল বিক্রি করতে রাজি করাতে হবে, এক্ষেত্রে তাদের প্রধান পুজি জনশক্তিকে দর কষাকষির হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে, কারণ খনি থেকে উৎপাদিত তেল বাজারজাত পর্যন- কষ্টকর শ্রমের বেশীর ভাগই এই দরিদ্র দেশের শ্রমিকদের । শিল্পোন্নত দেশ সমূহ যদি তুলনামুলক বেশী দামে তেল কিনতে বাধ্য হয় তাহলে তারা তেলের বিকল্প উদ্ভাবনে আরও বেশী মনোযোগী হবে, আর এ ক্ষেত্রে তাদের অগ্রগামী প্রযুক্তি ও আর্থিক সামর্থ সহায়ক হবে যার লাভ সবাই ভোগ করবে। রেশনিং ব্যবস'ায় এই সমস্যার কোন দীর্ঘ মেয়াদী সমাধান হবেনা কারণ প্রসাশনিক ব্যয় যুক্ত হওয়ায় তা তেল ব্যবহার জনিত মোট ব্যয়কেই বাড়িয়ে দেবে। বরং বর্তমান ব্যবস'ায় তেলের সর্বোচ্চ বিকল্প ব্যবহার নিশ্চিত করা সহ এক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত বাধা উত্তোরনে কাজ করতে হবে, কারণ পৃথিবীতে তেলের মজুদ যাই হোক না কেন তার নিশ্চয় একটা সীমা আছে। কৃষি উৎপাদন বাড়ানো গেলে জৈব জ্বালানী হতে পারে এর ধন্বনতরী সমাধান।
পেটের দায়ে বাংলাদেশের কৃষকের সাথে আমার অনেক দিনের কর্ম নিবাস। তাছাড়া জেনেটিক্যালি স্বগোত্রীয় হওয়ায় তাদের জীবন আমার কাছে নতুন নয়, যা নতুন তা হচ্ছে ভিন্ন অবস'ানের কারনে তাদের জীবনকে ভিন্ন আলোয় দেখা। সমপ্রতি দেশে মাত্র বিশ-পচিশ লাখ টন খাদ্য ঘাটতির আশংকা দেখা দিলে সবার মাথা খারাপ হবার যোগার হয়েছিল, কিন' বছরের পর বছর কোটি কোটি টন খাদ্য ও অন্যান্য শস্য সরবরাহ করছে এই কৃষকেরা প্রায় কোন রকম সহযোগীতা ছাড়াই, এর আর্থিক মূল্য অচিন-নীয়। যদি এক বছর বাংলার কৃষকেরা কোন আবাদ না করে তাহলে যে খাদ্যের দরকার হবে তা মেটানোর ক্ষমতা কি কারও আছে? অথচ নীতি নির্ধারন থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ে কৃষি ও কৃষকের যা গুরুত্ত্ব পাওয়া উচিৎ ছিল তার কিছু মাত্রও পায়নি। যার ফলে বাংলাদেশের কৃষি এখনো প্রায় সম্পূর্নই কায়িক শ্রম নির্ভর, অথচ সামান্য কিছু প্রযুক্তির ব্যবহারে এই শ্রম অর্ধেকেরও বেশী লাঘব করা যায়। কৃষকের জীবন ঘনিষ্ঠ থাকার ফলে তাদের দক্ষতা, সূযোগ, দূর্বলতা ও প্রতিবন্ধকতা খুব কাছে থেকে দেখে আমার মনে হয়েছে এই কৃষক কুলের তথা সমগ্র দেশের ভাগ্য বদল তেমন কোন কঠিন কাজ না। বাংলাদেশে যে নীতি মালা প্রচলিত আছে এবং বাজেটে যে বরাদ্দ আছে তার সামান্য কিছু রদ-বদল/সমন্বয়েই এটা সম্ভব। কারণ ইতোমধ্যে তারা প্রমান করেছে তাদের কাছে বণ্যা-খড়া-মঙ্গা বা ঘুর্নিঝড়তো নস্যিমাত্র, সিডরও কোন ‘ব্যাপারই না’।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জ্বালানী তেলের সাথে খাদ্য সমস্যা অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত, কারণ কৃষি উৎপাদন ব্যয় ছাড়াও জীবনযাত্রার নানা ক্ষেত্রে এর প্রভাব বিদ্যমান যা অন্যান্য স্বল্প আয়ের দেশের জন্যও প্রযোজ্য। কিন' বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সার বিতরন ব্যবস'ার দৈন্যতা প্রমানিত সত্য। তাই ভ'র্তুকী বা রেশনিং ব্যবস'ায় সরকারের প্রসাশনিক ব্যয় ও কৃষকের ভোগানি- জনিত ব্যয় সার ব্যবহার জনিত মোট ব্যয়কে অদৃশ্য ভাবে বাড়িয়ে দেয়। তেলের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সার বা তেলের ভ'র্তূকি তুলে নিলে কৃষকের উৎপাদন খরচ চালের হিসাবে কেজী প্রতি ৩ থেকে ৫ টাকা বৃদ্ধি পেতে পারে তাতে সন্দেহ নাই কিন' উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে পারলে সমস্যা থাকে শুধু নিয়োজিত পুজির। কারণ বেশী পুজি বিনিয়োগ করে উৎপাদিত ফসল বেশী দামে বিক্রয় করতে পারলেই কৃষকের মুনাফা নিশ্চিত হবে। কিন' আমরা কোন দৃশ্যমান ও যৌক্তিক কারণ ছাড়াই হর হামেশাই কেজীতে ৫ থেকে ১০ টাকা বেশী দাম দিয়ে চাল কিনতে বাধ্য হই কোন প্রতিবাদ ছাড়াই। দান-খয়রাতি সাহায্য দিয়ে এ সমস্যার দীর্ঘ মেয়াদী সমাধান হবেনা, প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। বাংলাদেশের অর্থনীতির নায়ক যে দরিদ্র কৃষক কুল তাদের আর্থিক ও অর্থনৈতিক জীবন খুব কাছে থেকে দেখার ফলে আমার মনে হয়েছে যে, তাদের পুজির দরকার আছে কিন' যত দরিদ্র তাদেরকে ভাবা হয় আসলে তারা তত দরিদ্র নয়। আমরা অতি সমপ্রতি লক্ষ্য করেছি মাত্র ২০/২৫ লাখ টন খাদ্য আমদানীর আশংকাতেই সংশ্লিষ্ট সবার ত্রাহি ত্রাহি অবস'া। আর বাংলাদেশের কৃষকেরা প্রত্যেক বছর প্রায় ৩ কোটি টন এর অধিক ফসল দেশকে দেয় প্রায় কোন রকম সহযোগীতা বা প্রতিদান ছাড়াই। এই বিশাল উৎপাদন ব্যবস'ায় যে মহা বিশাল পুজি জড়িত তার অতি ক্ষুদ্র অংশই প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে সরবরাহকৃত, প্রায় পুরোটাই কৃষকের প্রচেষ্টায় সংগৃহীত আর মোট পুজির তুলনায় প্রদত্ত ভ'র্তুকীতো নস্যি মাত্র। বর্তমানে দেশের যে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ কাঠামো তা থেকে প্রকৃত কৃষকেরা প্রায় কোন সুবিধাই পায়না, যা পায় তাও সময়মত পায়না। কৃষি উৎপাদনে জড়িত কৃষকের আর্থিক প্রয়োজন কেবল চাষাবাদের মৌসুমেই নয়, বরং সারা বছরই তার বিভিন্ন পরিমানে আর্থিক প্রয়োজন দেখা দেয়। বাস-বতার আলোকে প্রচলিত ব্যবস'ার বাইরে কৃষি উৎপাদনের জন্য একটি প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ কাঠামো দরকার যা সত্যিকার অর্থেই কৃষকের জন্য উপকারী এবং লাভজনক হবে, যা হতে পারে বাণিজ্যিক চলতিমুলধন/নগদ ঋণের আদলে গৃহস'ালী ঋণ বা অন্য কিছু।
বর্তমান ব্যবস'ায় কৃষকের আবেদনের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার আলোকে ব্যাংক সমূহ তার চাষাধীন জমির পরিমান ও ফসলের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ঋণ মন্জুর ও বিতরন করে থাকে। শস্য ঋণ সাধারনত এক কিসি-তে ফসল চাষের সময় বিতরন ও উঠার সময় আদায় করা হয়। এই পদ্ধতিতে নির্দ্দিষ্ট ফসল বপনকালে ঐ ফসলের সমুদয় উৎপাদন খরচ এককালীন ঋণ হিসাবে প্রদান করা হয়। এবং ফসল উঠার প্রায় সাথে সাথেই ঋণের টাকা সূদসহ আদায় করা হয়। ঋণ উত্তোলনের পর একবারেই সব অর্থ ব্যয় হয়না, কিন' ঋণের সূদ গুনতে হয় ষোল আনা সারা বছর। আবার বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে ঋণের অর্থ অন্য খাতে ব্যয় হয়ে যায়। ফলে সেচ, সার-কীটনাশক ইত্যাদি কাজে ব্যয় করার জন্য হাতে সময় মত অর্থ থাকেনা এবং উৎপাদন ব্যহত হয়। অধিকাংশ সময় কৃষকেরা ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া সত্ত্বেও ফসল ওঠার আগমূহুর্তে চড়া সূদে মহাজনদের কাছ থেকে ধার নিতে বাধ্য হয়। আবার বপনের সময় বেশী দামে বীজ কিনে ফসল উঠার সাথে সাথে তুলনামুলক কম দামে ফসল বিক্রয় করতে হয় ঋণ পরিশোধের জন্য। ফসল ওঠা মাত্রই মহাজনরা তাদের পাওনা টাকা নিয়ে যায়, ব্যাংকের টাকা অনাদায়ী পড়ে থাকে। আংশিক টাকা ব্যাংকে জমা দিলে আবার তা ওঠানো যাবেনা ফলে পরবর্তী ফসলের সময় আরও বড় সমস্যা হবে ভেবে অনেকেই হাতে কিছু টাকা থাকা সত্ত্বেও ব্যাংকের টাকা আংশিক পরিশোধ করেনা। কালক্রমে তা শ্রেনীকৃত তথা কু ঋণে পরিনত হয়। এক সময় সূদে আসলে ঋণের টাকা পরিশোধ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে কৃষকেরা নিজেরাও অর্থনৈতিক ভাবে পঙ্গু হয়ে যায়। প্রকৃত পক্ষে একজন কৃষককে প্রচলিত নিয়মে নিয়মিত ঋণ নেয়া-দেয়া করতে হলে তার উৎপাদিত ফসল বেচতে হবে সংশ্লিষ্ট ফসলের জীবনচক্রে সর্ব নিম্ন দামের সময়, আর প্রয়োজনীয় ফসল বা বীজ কিনতে হবে সর্বোচ্চ দামের সময়।
বাংলাদেশের সাধারন কৃষকদের জীবন ধারন সময়ের সাথে সাথে চ্যালেনজিং হয়ে উঠেছে। সরল উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যে কৃষক নিপুন শিল্পি তার অর্থনৈতিক জীবনেও এসেছে বহুমাত্রিকতা। বেশীর ভাগ কৃষকপরিবারের জীবন ধারনের জন্য যথেষ্ট ভূমি নাই। সে জন্য তাকে হতে হয় অতি হিসেবী। যেমন; ফসল উৎপাদনের বীজ সে যথাসম্ভভব নিজের উৎপাদিত ফসল থেকে সংগ্রহ করে, যদি একান-ই সম্ভভব না হয় তবে ঐ নির্দ্দিষ্ট ফসল উঠার সময়ই প্রয়োজনের চেয়ে সাধ্যমত বেশী কিনে রাখার চেষ্টা করে, কারন এ সময় উক্ত ফসলের দাম তুলনামুলক কম থাকে এবং বপনের সময় দাম বেশী থাকে। বপনের সময় অতিরিক্ত বীজ বিক্রি করে অন্যান্য ব্যয় নির্বাহ করে থাকে। আবার সুযোগ পেলে বাজারে যখন যে ফসলের দাম কম থাকে তা কিছুটা কিনে রেখে দাম বাড়লে বিক্রয় করে। অর্জিত মুনাফা তার জীবনকে সহজ করে। এভাবে খুব সাবধানে এবং ধীর গতিতে প্রায় কৃষকই শস্য কেনা-বেচার ব্যবসায় নিয়োজিত। অনেক অঞ্চলে যেটা ‘বান্দাই’ হিসেবে পরিচিত। এছাড়াও বছরের বিভিন্ন সময় সাময়িক ভাবে বিভিন্ন আয় উৎসারী কর্মকান্ডে নিয়োজিত থাকে। প্রায় সকল কৃষকই বহুমাত্রিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে তাদের জীবনের চাকা সচল রাখে, এখন আর কেউ কেবলমাত্র কৃষক বা কৃষি শ্রমিক নয়। শস্য ঋনের টাকা আনুষ্ঠানিক ঢঙ্গে বিতরন না করে যদি একজন কৃষকের বাৎসরিক চাহিদা এবং তার ঋণ প্রাপ্তির যোগ্যতার ভিত্তিতে সর্বোচ্চ ঋণ সীমা নির্ধারন করে চলতি/নগদ মূলধন ঋণের ন্যায় ঋন হিসাব সৃষ্টি করা হয় যেখানে ঋণগ্রহীতারা নির্দ্দিষ্ট সময় অন-র সূদ পরিশোধ সাপেক্ষে প্রয়োজন মত লেন-দেন করতে পারবে তাহলে ঋনের টাকার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত হবে যার ফলে সার্বিক উৎপাদনশীলতাও বৃদ্ধি পাবে এবং ঋণ ব্যবহার জনিত ব্যয় হ্রাস পাবে কিন' ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে।
খাদ্য রেশনিং কোন ভাবেই কাম্য নয়, অন-ত পরিমানেতো নয়ই। এটা ঠিক যে বাংলাদেশ খাদ্যে সয়ংসম্পূর্ন নয়, আভ্যন-রীন ভাবে প্রয়োজনের চেয়ে কিছু কম খাদ্য শস্য উৎপাদিত হয়। তবে এ ঘাটতি পুশিয়ে দেয় ঐ দরিদ্র কৃষকেরাই বছরের খানিকটা সময় (মঙ্গা,বন্যা,খড়া ইত্যাদি দূর্যোগকালে) একবেলা/দুবেলা না খেয়ে বা কম খেয়ে। এক্ষেত্রে রেশনিং তাদের জন্য মরার ওপর খাড়ার ঘা এর মত হবে। বরং এজন্য উৎপাদন বৃদ্ধিই একমাত্র সমাধান। আমার বিশ্বাস পরিকল্পিতও সমন্বিত উৎপাদন ব্যবস'ায় বাংলাদেশের শস্য উৎপাদন বর্তমানের চেয়ে শতকরা ২০-৫০ ভাগ বৃদ্ধি করা সম্ভব অনায়াসেই। এখনো প্রতি বছর বিপুল পরিমানে শস্য উৎপাদনযোগ্য সরকারী-বেসরকারী জমি অনাবাদী পড়ে থাকে। আবার যেগুলিতে চাষ করা হয় তার ফসল নির্বাচনও খুব একটা যৌক্তিক ও সর্বোচ্চ লাভজনক নয়; সময়োপযোগী তথ্য, প্রযুক্তি ও উপকরনের অভাবে। সরকারের এক ঘোষনায় এক বছরের মধ্যে দেশের চাহিদা মিটিয়েও আভ্যন-রিন মোট উৎপাদিত খাদ্য শস্যের শতকরা প্রায় তিরিশ ভাগ বিশ্ব বাজারে রপ্তানির জন্য খাদ্য আমদানী কারক বিভিন্ন দেশে রোড শো এবং নৈশ ভোজের আয়োজন করার সূযোগ এন দিতে পারে কর্তাদের। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ভয়াবহ সিডরে পাকা ধানে মই দিয়ে গেলে দেশে সাময়িক খাদ্য সংকটের আশংকায় কৃষি কর্তা ও এর পরম্পরায় কর্তা/মহাকর্তারা ঘোষনা দিয়েছিলেন “দেশে এক ইঞ্চি আবাদী জমিও পতিত থাকবে না”। কিন' কে, কোথায়, কেমনে আবাদ করবে নাকি আবাদ করার জন্য কোন দেব দুতের আগমন ঘটবে তা কেউই স্পষ্ট করেননি। কিন' আমার কাছে যা স্পষ্ট তা হচ্ছে-রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক গুলিকে শস্য ঋণ প্রদানে নীতি সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশে আবাদযোগ্য প্রায় সকল ফসলের একর প্রতি উৎপাদন খরচ এবং ফসল ভিত্তিক জমির মৌসুমি ভাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারন করাই থাকে, সেটাকে আরও বিজ্ঞান সম্মত করা যেতে পারে, সেই সাথে দরকার ছোট-খাট কিছু আইনী পরিবর্তন ও সমন্বয়। যেমন, কেউ তার নিজের জমি তিন মাসের বেশী ফেলে রাখতে পারবেনা, রাখলে ঐ জমিতে স্বল্পতম সময়ে উৎপাদিত ফসলের জন্য মৌসুমী ভাড়ার সমপরিমান জরিমানা দিতে হবে। তবে সে নিজে অন্য কাউকে ভাড়া দিতে অক্ষম হলে কৃষি কর্মীকে জানালেই তার দায়িত্ব শেষ। চাষীরা হয় নিজেরাই অথবা কৃষি কর্মীর মাধ্যমে (সমবায় পদ্ধতি বা কৃষি সমপ্রসারন বিভাগের তত্ত্বাবধানে) সহজেই জমি চাষের জন্য ভাড়া নিতে পারবে, একই জমিতে একাধিক চাষী আগ্রহী হলে নিজেদের মধ্যে লটারী করে নেবে। এছাড়া আবাদযোগ্য সরকারী জমি একই ভাবে ফসল ভিত্তিক ভাড়া নেয়ার ব্যবস'া থাকবে, অধিগ্রহণকৃত জমিতেও কাজ শুরুর আগে স্বল্পকালনি সব্জি চাষ করা যেতে পারে। সরকারী লোকদের পরিবারসহ প্রায় অর্ধ কোটি সদস্যারা শুধু খায়, বেশী খায়, কখনো কম খায়না, কিন' খাদ্য শস্য উৎপাদনে যে মহান কৃষকের অবদান, খাবার কম পড়লে তারাই নিজেরা কম খেয়ে, কখনো না খেয়ে এই ঘাটতির সমন্বয় করে। তাই তারা এই মহা নায়কদের বিভিন্ন স্বাস'কর ফল খাওয়ার ব্যবস'া করতে পারে, তারা তাদের অফিস-আদালত, সরকারী আবাসন সহ যত অব্যবহৃত খালি জায়গা আছে সেগুলির কোন স'ায়ী পরিবর্তন না করে , যেগুলি বিশেষ কারণে সীমাবদ্ধ তা ছাড়া সমপূর্ণ টাই স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী বিভিন্ন কম ব্যপ্তি সম্পন্ন ফলের গাছে পূর্ন করে দিতে পারে। উৎপাদিত ফল কে পেল আর কে খেল সেটা বড় নয়, বড় কথা হল দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধিতো হলো। খুব সহজেই হতে পারে বাংলাদেশের সবচেয়ে কম খরচের পানীয় খাঁটি ফলের রস, আর কেনা জানে রসের প্রতি রসনার আসক্তি।
বাংলাদেশের কৃষকেরা যে পরিমান ফসল উৎপাদনের জন্য যে পরিমান কায়িক শ্রম ব্যয় করেন তা পৃথিবীর অন্য কোন দেশের কৃষক করেনা বলেই আমার ধারণা। যদিও আমি অন্য কোন দেশের কৃষক দেখিনি তবে আমার বিশ্বাস বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস'ায় যন্ত্রের ব্যবহার সম্ভবত পৃথিবীতে সবচেয়ে কম বা তার কাছাকাছি। তাই নীতিগত ভাবে বাংলাদেশের কৃষকদের উৎপাদিত ফসলের মূল্য অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশী হওয়া উচিৎ, কারণ বর্তমানে খুব সামান্য বিনিয়োগেই কৃষি জমি চাষ থেকে শুরু করে ফষল কর্তন পর্যন্ত প্রায় সব কাজই যান্ত্রিক উপায়ে করা যায়। অথচ বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা মুলত কৃষকের কায়িক শ্রম নির্ভর যা খুব সহজেই যান্ত্রিক উপায়ে প্রতিস্থাপনযোগ্য এবং তাতে ফসল উৎপাদনের প্রকৃত খরচও হ্রাস পাবে বহুলাংশে, আবার কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে অবমুক্ত শ্রম শক্তির সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার সার্বিক ভাবে দেশজ উৎপাদন বাড়াবে ও মানুষের জীবন-মান এর উন্নয়ন ঘটাবে। রাষ্ট্র ব্যবস্থা কোন রকমে দরিদ্র কৃষকদের বাচিয়ে রেখেছে প্রায় বিনা পয়সায় কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রাখার জন্য। অথচ সার ও তেলে যদি কোন ভ'র্তুকী না দিয়েও সম পরিমান অর্থ কৃষি যন্ত্র-প্রযুক্তি-উপকরন খাতে বরাদ্দ দেয়া হয় তাহলে অচিরেই বাংলায় কৃষি বিপ্লব ঘটতে বাধ্য। কারণ সরকার যদি প্রতিটি গ্রামে সমবায়ের বা অন্য কোন ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে একটি করে কলের লাঙ্গল দিতে চায় তবে তা মাত্র পাঁচ হাজার কোটি টাকা খরচেই সম্ভব যা চলতি বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা ও ক্ষমতায়ন খাতে যা বরাদ্দ আছে (প্রায় ১৮ হাজর কোটি টাকা) তার এক তৃতীয়াংশেরও কম। অথচ বৃহত্তর স্বার্থে কৃষি উৎপাদনে বিনিয়োগই সর্বাধিক লাভজনক এবং কৃষিতে যত বেশী যন্ত্র ও প্রযুক্তির ব্যবহার হবে তা তত বেশী লাভজনক হবে এবং কৃষিতে যন্ত্রায়নই কৃষি বিপ্লবের কামানের গোলা।
বর্তমানের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্বকে নিয়ে এসেছে হাতের মুঠোয়, আর বাংলাদেশ ভৌগলিকভাবে খুবই ছোট্র একটি দেশ। প্রতিটি গ্রামকে উন্নয়নের একক (সমবায় বা অন্য কোন আদলে) ধরে একটি জীবন্ত নেটওয়ার্কের আওতায় আনা যায় সহজেই। কারণ লাখ খানেক এককের নেটওয়ার্ক নজরদারী করা সম্ভব সার্বক্ষনিক ও কেন্দ্রীয় ভাবে। এজন্য নতুন বা বিশাল ব্যয়বহুল কোন প্রযুক্তির প্রয়োজন নেই আদৌ। কেবল প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা ও উদ্যোগ।
No comments:
Post a Comment