Sunday, June 5, 2011

বাংলাদেশের এসএমই খাতের উন্নয়ন এবং (অ)প্রাসংগিক কিছু কথা!


স্মল এন্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ (এসএমই) খাত এর উন্নয়ন নিয়ে ইদানিং বেশ হইচই হচ্ছে। ‍‍‍”দেশের সামগ্রীক উন্নয়নে এসএমই খাতের উন্নয়নের বিকল্প নেই- এ ব্যাপারে সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক, ব্যবসায়ী সমাজ, অর্থনীতিবীদ, দাতাগোষ্ঠি সবারই এক‍’রা। বিশেষ করে মাইক্রোক্রেডিটের সুনামে ভাটা পরায় এর কদর এখন উর্ধমূখী। বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৬ সালে এসএমই ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে প্রতি বছর বাজেট দিয়ে আসছে। এই ধারাবাহিকতায় চলতি বছর (২০০৯-১০) ১২.৯১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছেবাংলাদেশ ব্যাংক এসএমই নীতিমালা করে ব্যাংকারদের জন্য গাইডলাইনও তৈরী করেছে চলতি বছর এ খাতে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ বরাদ্দের টার্গেট দেয়া হয়েছেদাতা-বন্ধু-পরামর্শক সবাই নানা দাওয়াই নিয়ে আসছে এ খাতের উন্নয়নেঅর্থনৈতিক উন্নয়ন, দারিদ্র বিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ইত্যাদি নানা সুন্দর সুন্দর কথা বলা হচ্ছে। এক সময় মাইক্রোক্রেডিট নিয়ে এরকম শোনা যেত, বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়ন ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য তা যুগান্তকারী সমাধান হিসাবে মনে করা হতো। এখন মাইক্রোক্রেডিটের সাফল্য শুধু প্রশ্নবিদ্ধই নয়, অধ্যাপক আনু মুহম্মদ এর মতে,বৃহৎ বাণিজ্যের একটি সফল মাধ্যম হিসেবে ক্ষুদ্রঋণ মডেল অবশ্যই স্বীকৃতি পেতে পারেকিন্তু দারিদ্র্য বিমোচন কিংবা নারীর ক্ষমতায়নে এর সাফল্যের দাবি ভ্রান্ত ও প্রতারণামূলক  মাইক্রোক্রেডিট কেবল ঋণের বাজারই সৃষ্টি করেনি, এর গ্রহিতাদের পরিনত করেছে ‘বন্ডেড লেবার’ এ। কার্যত: মাইক্রোক্রেডিট স্বল্প সময়ে অধিক মুনাফা সৃষ্টির সস্তা ও খুবই কার্যকর একটি হাতিয়ার
বর্তমানে মাইক্রোক্রেডিটের “বৃহৎ বাণিজ্যের” এই বাজার নানা কারনে সংকুচিত হয়ে আসছে। পুজির চিরন্তন স্বভাব অনুযায়ী তা এখন নতুন বাজার খুজবে এটাই স্বাভাবিক। স্বভাব গুণে বা দোষে যাই হোক, পুঁজির স্বভাব হলো ছড়িয়ে পড়া, মুনাফা হয়ে আত্মস্ফীতি ঘটানো এজন্য বাজার ন্তহীনভাবে বেড়ে চলতে হবে মুনাফায় আত্মস্ফীত পুঁজিকে পুনঃ পু্নঃ বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টির জন্য বর্তমান সাম্রাজ্যবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় শ্রমিক শ্রেণীকে শোষণের মাধ্যমে উদ্বৃত্ত মূল্যের উৎপাদন হয় আর এই উদ্বৃত্ত উৎপাদন ভোগ করে পুজিপতিরা। আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নীকারী প্রতিষ্ঠানসহ তথাকথিত দাতারা পুজি’র জন্য লাভজনক বাজার ও  নিরাপদ অবকাঠামো তৈরী করে থাকেযেমনটি মাইক্রোক্রেডিটের ক্ষেত্রেও করেছে। পুজির নতুন বাজার হিসাবে এখন তাদের চোখ পরেছে এসএমই এর দিকে। এ বাজার মাইক্রোক্রেডিটের চেয়ে অনেক বড়, বিস্তৃত ও সম্ভাবনাময়। “বৃহৎ বাণিজ্যের” এক  বাজার শেষ না হতেই আরেক দিকে বাম্পার বাণিজ্যের মহাবাজার এর হাতছানিপুজির জন্য এর চেয়ে বড় সুখবর আর কি হতে পারে! বস্তুত: এসএমই উন্নয়নের  নামে বর্তমানে যা কিছু হচ্ছে তার আসল লক্ষ্য পুজি লগ্নির নতুন অবকাঠামো তৈরী ও  ঋণের বাজার সৃষ্টি। আর এজন্যই দাতা-সরকার সকলেই এসএমই খাতের উন্নয়ন মাপছে এই খাতে ঋণ প্রবাহের পরিমান দিয়ে। আসলে দাতাদের তথাকথিত উন্নয়ন কেবল বাণিজ্য’র সহায়ক শক্তিই নয়, উন্নয়ন  নিজেও এখন বাণিজ্য হিসাবে সফল ও লাভজনক, আর তা সর্বজন বিদিত। স্থানীয়, জাতীয়, আন্তর্জাতিক সকল ক্ষেত্রে একই চিত্র দৃশ্যমান
দাতাগোষ্ঠি থেকে শুরু করে সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক, মহাজন ব্যাংক, নানা নামের নানা ঢং এর আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ সবারই নজর এখন এসএমই এর দিকে। কিন্তু সব এসএমই এর দিকে নয়, শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠিত ও লাভজনকভাবে পরিচালিত এসএমই এর দিকে। যারা অনেক বন্ধুর পথ পারি দিয়ে এখন একটা সুবিধাজনক অবস্থায় এসেছে তাদের লাভে ভাগ বসানোর জন্যই এতো আয়োজনবাংলাদেশের এসএমই খাতের উন্নয়নের জন্য এডিবি ১২৬.৬৭ মিলিয়ন ডলারের প্রকল্প হাতে নিয়েছে (প্রকল্প নং-৩৬২০০, আগষ্ট ২০০৯। প্রকল্পের মেয়াদ অক্টোবর ২০০৯ হতে সেপ্টেম্বর ২০১২) । এই প্রকল্পে এডিবি  ৭৬ মিলিয়ন ডলার দেবে ৮ বছরের গ্রেস পিরিয়ড সহ ৪০ বছরে পরিশোধযোগ্য ঋণ হিসাবে। যার সূদের হার গ্রেস পিরিয়ডে ১% এবং অবশিষ্ট সময়ের জন্য ১.৫% । স্বল্প সুদের কারণে দৃশ্যত এটি একটি মহৎ উদ্যোগ মনে হলেও এর আসল মাজেজা অন্য জায়গায়। কারণ এই ঋণ ডলারে পরিশোধ করতে হবে। আর অতীত অভীজ্ঞতানুযায়ী টাকার অবমূল্যায়নের ধারবাহিকতায় আগামী ৪০ বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান বর্তমানের অর্ধেকেরও নীচে নেমে আসবে। বর্তমান বৈশ্যিক আর্থিক ব্যবস্থার কারনেই তা অনিবার্য। ফলে  গৃহিত অর্থের বহুগুন বেশী পরিশোধ করতে হবে ভবিষ্যতে। শুধু কি তাই! এই ঋণের সাথে বিনামূল্যে আরো আছে হাজারো শর্তের বেড়াজাল।  এই ঋণ বা বিনিয়োগের আসল লক্ষ্য মুনাফা কামানো নয়, শর্ত দেবার ক্ষমতা অর্জন পুজি’র সুবিধামত সবকিছু সংস্কার, বদল করার শর্ত সবধরণের পুঁজি যাতে নির্বিঘ্নে কারবার করতে পারে তার ব্যবস্থা করার ক্ষমতা অর্জন বিশ্বব্যাংকের সূত্রে এডিবি’র হিসাব মতে ২০০৬ সালে দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারী এন্টার প্রাইজ এর সংখ্যা ছিল মোট ৬.৮ মিলিয়ন (সে হিসাবে ২০১০ সালে তা বেড়ে দাড়িয়েছে ১০মিলিয়নে এবং লাভজনক ও নিশ্চিত বিনিয়োগের সূযোগও আনুপাতিকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে), তাদের মধ্যে কমপক্ষে ১ মিলিয়ন সফল উদ্যোক্তা আছে যাদের কাছে নিশিন্তে ৩৯৫.৯৭ বিলিয়ন টাকা বিনিয়োগ করা যায়। নতুন এসএমই প্রতিষ্ঠা বা কোন রকমে টিকে থাকাদের উন্নয়নের কোন ব্যবস্থা এই প্রকল্পে নেই। কারণ প্রকল্পটির উদ্দেশ্যই ঋণের এই বিস্তৃত নতুন বাজারে পুজি’র মুনাফা নিশ্চিত করা, এসএমই খাতের উন্নয়ন নয় সব ধরণের পুঁজি যাতে নিরাপদে স্ব স্ব কারবার করতে পারে তার পরিবেশ তৈরী করাই দাতাগোষ্ঠীর কাজ সেই পুজির বিকাশ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক বা সরকার প্রচ্ছন্নভাবে সহায়কের ভূমিকা পালন করছে । বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই ঋণনীতিমালা অনুযায়ী যেসব উদ্যোক্তাদের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা ও স্বামর্থ আছে কেবল তারাই এই ঋণ পাওয়ার যোগ্যতেলীর মাথায় তেল নয়, এ যেন পুটিমাছ দিয়ে বোয়াল ধরা আর কি! বিশ্বপুজির নিয়ন্ত্রকেরা হয়ত গোটাকয়েক নোবেল প্রাইজও খরচ করবে এই ঋনের বাজার সৃষ্টি ও বৃদ্ধিতে অসামান্য অবদান রাখার জন্য! কারণ মাইক্রোক্রেডিটের চেয়ে এই বাজার বহুগুন বড় এবং তা উত্তোরত্তর বাড়তেই থাকবে। আমাদের মধ্য বিত্ত সমাজের যে অংশ এতদিন ঋণের জালের বাইরে ছিল এবার তাদের শিকার করার জন্যই এসএমই নামক এই পুটিমাছের বিকাশ ঘটাতে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ তথাকথিত সকল দাতা গোষ্ঠীদের এতো এন্তেজাম এবিষয়ে পুজিবাদের সূবিধাভোগী সকল পক্ষই দেশ-কাল-পাত্র নিরপেক্ষভাবে একাট্টা । আর আমরাও তাদের স্থানীয় এজেন্ট তথাকথিত বুদ্ধিজীবি, সূশীল সমাজ, উন্নয়নবিদ, অর্থনীতিবিদদের কথামালার গোলক ধাধায় পরে উন্নয়ন নামক অদৃশ্য মূলা’র পিছে  ছুটছি রাঘব বোয়ালদের খোরাক হতে
বর্তমান পুজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থায় আমরা চাইলেই এই জাল থেকে বেড়িয়ে আসতে পারবনাতারপরও আমাদের জাতীয় নীতিমালা ও নানা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জনগনের স্বার্থ রক্ষার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু এক্ষেত্রে সরকার দায়িত্বপালনে শুধু ব্যার্থই নয় বরং উল্টো ভূমিকা পালন করছে জনস্বার্থের বিপক্ষে, পুজির পক্ষে। এখনই সময় সঠিক সিদ্ধান্ত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহনের। দাতাদের প্রেশক্রিপশন মোতাবেক এসএমই এর উন্নয়ন নয়, আমাদের প্রেক্ষাপটে আমাদের প্রয়োজনে আমাদের মত করেই এন্টারপ্রেনর (সুউদ্যোক্তা) সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সত্যই এসএমই এর বিকল্প নেই, কিন্তু সেজন্য এন্টারপ্রাইজের উন্নয়নের মাধ্যমে নয় (সেটা সম্ভবও নয়),  গুরুত্ব দেয়া দরকার এন্টারপ্রেনর  সৃষ্টি ও উন্নয়নের দিকে তাহলে এন্টারপ্রেনরই এন্টারপ্রাইজ তৈরী করবে, সেটা ছোট, বড় না মাঝারী তা সময়ই ঠিক করে দেবে। সত্যিকার অর্থে এসএমই খাতের যে উন্নয়ন দেশের জন্য ভবিষ্যতে মঙ্গল বয়ে আনবে তা কেবলমাত্র এন্টারপ্রেনর সৃষ্টি ও তাদের উন্নয়নের মাধ্যমেই সম্ভব নইলে আমরা পুজির শৃঙ্খলে নানা প্রকল্পের অবজেক্ট/বেনিফিসিয়ারী বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য গিনিপিগ হয়েই থাকব। স্বচেষ্টায় এবং কঠোর পরিশ্রমে নানা প্রতিকুলতা পারি দিয়ে যারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ও হচ্ছে তাদের নিয়ে বাণিজ্য হবে আর হাজারও সম্ভাবনা নিরবে ঝরে যাবে নিত্যদিন। তাই আমাদের সকল নীতিমালা ও কর্মসূচী কেবল কাগজে-কলমে এন্টারপ্রেনর বান্ধব করলেই হবেনা; দীর্ঘ মেয়াদী ও সামগ্রীক পরিকল্পনার মাধ্যমে এদেশকে করতে হবে এন্টারপ্রেনর সৃষ্টির উর্বর ভূমি কেবল নামমাত্র কিছু প্রকল্পের মাধ্যমে জনগনের অর্থের শ্রাদ্ধ নয়। সুপরিকল্পিতভাবে এন্টারপ্রেনর তৈরীর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। তবেই আমাদের এই বিশাল জনগোষ্ঠী অন্যের মুনাফা অর্জনের হাতিয়ার না হয়ে আত্ননির্ভরশীল জন সম্পদে পরিনত হবে। এদশের মানুষ যে উৎপাদনশীল ও নূন্যতম সম্পদেই তারা জীবন যুদ্ধে জয়ী হতে পারে তার বহু নজির আমাদের চারপাশেই বিদ্যমান। তাই, এসএমইকে শোষনের হাতিয়ার হিসাবে সৃষ্টি ও ব্যবহার না করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্র হিসাবে বিকশিত করার জন্য কার্যকর ও সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহনের এখনই সময়।     

No comments:

Post a Comment