বর্তমান বাংলাদেশে কোন রকমে বেঁচেবর্তে থাকার জন্য একটা চাকরি বা কাজ পাওয়া আজকাল শুধু সোনার হরিণই নয়, রীতিমত যেন ইউরেনিয়ামের হরিণ। হাজারো সম্পদ চারিদিকে ছড়ানো, ব্যাংকে হাজার কোটি টাকার অলস গড়াগড়ি, যেদিকে চোখ যায় শুধু কাজ আর কাজ অথচ সে কাজ পরে আছে কর্মীর অভাবে। চারিদিকে হাহাকার, শুধু নাই নাই আর নাই। লক্ষ মেধাবী তরুন বেকার ঘুড়ে বেড়াচ্ছে কাজের অভাবে, নিরবে ঝরে যাচ্ছে হাজারো সম্ভাবনা। অথচ আজকের যে বেকার সন্তানটি পরিবার, সমাজ ও দেশের বোঝা, সামান্য সূযোগ পেলেই উল্টো সে নিজেই টানতে পারে পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্রের বোঝা। স্বাধীনতার প্রায় চার দশক পেরোলেও উৎকৃষ্টমানের চাকর তৈরীর লক্ষ্যে বৃটিশ আমলে যে শিক্ষা ব্যবস্থার শুরু তার গতরে লাগেনি আজো কোন মৌলিক পরিবর্তনের ছোয়া। লুন্ঠন আর নির্যাতনের হাতিয়ার থেকে এখনো আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা কল্যাণমূখী হয়ে উঠতে পারেনি। আমাদের রাষ্ট্র বা শিক্ষা কোন ব্যবস্থাই আমাদের সম্ভাবনাগুলোকে বিকশিত হবার জন্যে সহায়ক নয়। প্রাকৃতিক, সামাজিক ও জ্ঞান সম্পদের উপড় সমঅধিকার মানবকুলের জন্মগত মানবাধিকার হলেও অল্পকিছু মানুষ বা শক্তি সবকিছু কুক্ষিগত করে রেখেছে নিজের করে, যেন আর কারো কোন অধিকার নেই। মানুষের রক্ষা কবচ না হয়ে রাষ্ট্র যেন রাক্ষসদের পক্ষ নিয়েছে! আর এজন্য আমাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে শিক্ষা ব্যবস্থাও সেভাবে সাজানো যাতে মানুষকে এই অদৃশ্য রাক্ষসরা অনায়াসেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা হয়তো ‘স্মার্ট’ চাকর তৈরী করতে পারে, কিন্তু এমন মানুষ তৈরী করতে পারেনা যারা শিক্ষা জীবন শেষ করে কাজের জন্য অন্যের মূখাপেক্ষী হয়ে বসে থাকেনা, চাকরী না পেলেও তাদের শিক্ষা জীবন ব্যর্থ হয়ে যায়না। এই না পারার পিছনে যত কারন আছে তার মধ্যে অন্যতম কারণ শিক্ষা জীবন থেকে কর্ম জীবনে প্রবেশের কোন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এখনো গড়ে উঠেনি, আর যারা অশিক্ষিত, অদক্ষ বা স্বল্প শিক্ষিত তাদের অবস্থা তথৈইবচ।
আমাদের স্বাভাবিক জীবনধারায় একটা বয়স পর্যন্ত কেউ জিজ্ঞেস করেনা সে কি করে, কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে চারিদিকের জিজ্ঞাসা ও মাথায় দু:চিন্তা দুটোই বেড়ে যায়। একটা কিছু করতে হবে; কিছু একটা করা দরকার! এমন টানাপোডেন এর সময় শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবার জীবনেই আসে। যারা সোনার চামচ হাতে-মূখে-পকেটে বা ব্যাংকে নিয়ে জন্মায় তাদের কথা আলাদা। এই যে “এখনো কিছু করিনা” পর্যায় থেকে “এখন কিছু করি” এই পর্যায়ে রুপান্তরের পরিবেশ ও শর্তাবলী তৈরীর দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কিন্তু নির্মম সত্য হচ্ছে স্বাধীনভাবে নিজস্ব সম্ভাবনা বিকাশের প্রাতিষ্ঠানিক ও আর্থসামাজিক পরিকাঠামো কোনটাই বিদ্যমান না থাকায় আমরা শেষ পর্যন্ত যা কিছুই করিনা কেন তা প্রায় সম্পূর্নটাই ‘চান্স’ বা সূযোগ নির্ভর। নিজের চাওয়া বা পরিকল্পনামাফিক চাকরি বা কাজ খুব কম মানুষের কপালেই জোটে। আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতি-কাঠামো বা আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘এখনো কিছু করিনা’ পর্যায় থেকে ‘এখন কিছু করি’ পর্যায়ে রুপান্তরের জন্য মাঝখানে ‘এখন কিছু করব’ এই পর্যায়ে সংযোগের কোন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নেই। ফলে কেউ কিছু করতে চাইলেও তার সূযোগ খুবই কম, আমাদের কর্মজীবনে প্রবেশের পথ নির্মম, বন্ধুর ও প্রকৃতি বা ‘চান্স’ নির্ভর। কিন্তু যারা যে কাজে দক্ষ বা যে কাজে যে আনন্দ পায় সেই কাজ যদি প্রচলিত আইনের সাথে সংঘাতপূর্ন না হয় তবে তা করার অধিকার আমাদের অন্যতম মৌলিক অধিকার-জীবনের প্রতি অধিকার, মর্যাদার সাথে বেচে থাকার অধিকার যা মহান সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদ দ্বারা সুরক্ষিত আছে (“প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানব সত্ত্বার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে”)। এজন্য প্রয়োজনীয় সকল শর্তাবলী নিশ্চিতকরণ ও তদানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহনে রাষ্ট্র দায় বদ্ধ।
বর্তমানে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা বা রাষ্ট্র ব্যবস্থা কোনটাই আমাদেরকে আমাদের মত করে বেচে থাকতে শেখায়না, বড়জোড় অনৈতিক বাণিজ্য সেখায়, পণ্য হিসাবে নিজেকে গড়ে তুলার তালিম দেয়। আমাদের এই ব্যবস্থা আমাদেরকে যতটা দামী পণ্য হিসাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করে, মানুষ হিসাবে ততটা নয়। পুজির শৃঙখলে আবদ্ধ আমাদের মানবিকতা বাণিজ্যের কাছে নতজানু হয়ে থাকে। অথচ প্রতিটি মানুষই সমান ও অসীম সম্ভাবনা নিয়ে জন্মায়। তাদের ভিন্ন ভিন্ন পরিনতির দায় আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা এড়াতে পারেনা।
সবাই সবকিছু পারেনা, পারার দরকারও নাই। কিন্তু প্রত্যেকেই কিছু না কিছু পারে। তবে কোন মানুষই জন্মের আগে থেকে কোন কিছু শিখে আসেনা বরঞ্চ জন্মে শিখে। মানুষ জীবনের প্রয়োজনে যা কিছু শেখে তার বেশীরভাগই সচেতন কোন প্রচেষ্টা ছাড়াই প্রাকৃতিকভাবে শেখে। আনুষ্ঠানিকভাবে যা কিছু শেখে তার অধিকাংশই বাস্তব জীবনে কোন ব্যবহারিক প্রয়োজনে আসেনা। তেমনি যা কিছু শেখার তার সব কিছুই কখনো শেখাও হয়না। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা যে শিক্ষা দেয় তা পরীক্ষার হলের বাইরে খুব একটা কাজে আসেনা। চাকরী না পেলে পুরো শিক্ষা জীবনই বৃথা। অথচ চাকরী জীবনেও ঐ শিক্ষার খুব একটা ব্যবহার নেই। যে পরিমান সময়, শ্রম ও সম্পদের বিনিয়ে যে ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন করি তা পর্বতের মুশিক প্রসবের ন্যায়। জীবনের জন্য বা বেঁচে থাকার জন্যেই যদি শিক্ষা হয় তাহলে আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশী। এই ব্যবস্থায় আমাদের প্রয়োজন, স্বামর্থ ও সম্ভাবনা অনুযায়ী শিক্ষা না দিয়ে বরঞ্চ শিক্ষা ব্যবস্থানুযায়ী বা অন্যের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী আমাদের স্বামর্থ গড়ে তোলার অমানবিক প্রচেষ্টা সর্বত্রই বিদ্যমান। অনেকের মতে এই ব্যবস্থা না থাকলেই ভালো হয়! কারণ এই ব্যবস্থা কেবল মাত্র উৎপাদন প্রক্রিয়া টিকিয়ে রাখার স্বার্থে নানা ছলে বলে আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া বলেই তারা মনে করেন।
বর্তমান উন্নয়ন জাতীয় নীতি-কাঠামোতে মানব সম্পদ উন্নয়ন মানে পুজি’র নিরন্তর মুনাফা সৃষ্টিতে প্রয়োজনীয় শ্রমের সহায়ক অবকাঠামো নিশ্চিতকরণ। অল্প কিছু সাহসী মানুষই এর বিরুদ্ধ স্রোতের মূখে মাথা তুলে দাড়াতে পেরেছে, দাড়াচ্ছে ও দাড়াবে। এই মানুষগুলোই আমাদের সভ্যতার প্রগতিকে নিত্য শক্তি যোগাচ্ছে সামনে এগিয়ে যাবার জন্য। এই শক্তি জোগানো মানুষগুলোই এন্টারপ্রেনর বা সুউদ্যোক্তা। এরা চাকরী বা কাজ খোজেনা, কাজ তৈরী করে, নিজর জন্যে, অন্যের জন্যে আবার দেশের জন্যেও। বাদবাকীদের অধিকাংশই কোন রকমে বেচে থাকে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কৃপায় বা বোঝা হয়ে। এন্টারপ্রেনর জন্মায় না, জন্মে সৃষ্টি হয়, তার পারিপার্শ্বিক অবস্থাই তাকে তৈরী করে। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং স্বল্প, মধ্য বা দীর্ঘ মেয়াদী রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন নীতি-কাঠামো এন্টারপ্রেনর সহায়ক/বান্ধব হলে আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠী অন্যের মুনাফা সৃষ্টির হাতিয়ার না হয়ে প্রকৃতপক্ষেই মানবসম্পদে পরিণত হবে । আমরা যখন সম্মিলিতভাবে সুউদ্যোক্তাদের প্রতি সুনজর দেব তখন বর্তমান সমাজের এই অসম চিত্র অবধারিত ভাবেই পাল্টে যাবে ।
No comments:
Post a Comment