Sunday, June 5, 2011

“আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও একুশ শতকের ভাবনা” নিয়ে অবান্তর কিঝু ভাবান্তর....!!!


গত ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০০৮ ইং তারিখ বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়স' আর সি মজুমদার মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত “আন-র্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও একুশ শতকের ভাবনা” শীর্ষক আলোচনা সভায় দর্শক-শ্রোতা হিসাবে আমার উপসি'ত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। বলা যায় অনেকটা হঠাৎ করেই অপ্রত্যাশিত ভাবে বেশ কিছু মহাপ্রাণ মানুষকে বেশ কাছে থেকে দেখার এবং শোনার সূযোগ এসেছিল আরেক চঞ্চল প্রান তরুনের কল্যানে। এমনধারা  উচ্চমার্গের আলোচনায় উপসি'ত থাকার সূযোগ খুব একটা আমার জীবনে আসে না। তাছাড়া যাদের জন্য এমন মহতী আয়োজন ও যারা এর উদ্যোক্তা তাদের উভয়ের কাছ থেকে ব্যক্তি আমার যোজন যোজন দুরত্বের কারনে এমন অনুষ্ঠানে উপসি'ত থাকতে পারাটা  আক্ষরিক অর্থেই আমার জন্য ছিল “অপার সম্ভাবনাময় অনায়াসলব্ধ সূযোগ”। কারণ সেখানে উপসি'ত ছিলেন দেশের অন্যতম তিন জন জীবন- কিংবদন-ী -আমার পরম প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় নাট্য ব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ, শিক্ষাবিদ ও গবেষক ড. আনিসুজ্জামান-যাকে দেখে মনে জোড় পাই এখনো দেশে নির্লোভ ভাল মানুষেরা আছে, কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন-যাকে দেখলে শুধুই আমার মায়ের মুখ মনে পড়ে যা আমাকে সম্মোহিত করে রাখে। তাই আমার ইন্দ্রিয় গুলিকে  তাদের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় কার্যকর রেখে সব শুনছিলাম,দেখছিলাম ও বোঝার ভাচেষ্টা (ভান মিশ্রিত চেষ্টা) করছিলাম।  
 
 অনুষ্ঠানের মূল প্রবন্ধ উপস'াপনায় বিষয় বৈচিত্র্যের চমৎকারিত্ব আমাকে অবিভূত করে দেয় (আলোচ্য প্রবন্ধটি দৈনিক সমকাল পত্রিকায় শুত্রুবার ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ ইং তারিখে ‘বাঙালি সংস্কৃতির চিরায়ত বৈশিষ্ট্য’ শিরোনামে প্রকাশিত হয় )। নিজেকে হতভাগ্য এবং বঞ্চিত জন মনে হচ্ছিল এধরনের আরও অনুষ্ঠানে উপসি'ত থাকার অভীজ্ঞতা স্মৃতিতে না থাকার কারনে। প্রবন্ধকার জনাব মনজুর রশীদ শুরুতেই একটা চমৎকার আদিম সত্য সবার সামনে নিয়ে আসেন যা আমরা সচরাচর খেয়ালই করিনা,তা হচ্ছে,মানব সভ্যতার সেরা সৃষ্টি হলো তার নিজের ভাষা। কেননা ভাষার কারণেই মানুষ আজ মানুষ,অন্য প্রাণীর চেয়ে আলাদা। জনাব রশীদ যখন বলেন -যে কথা বলতে পারেনা (বোবা) তারও একটা ভাষা আছে,তখন তার পর্যবেক্ষনের তীক্ষ্নতা এবং নান্দনিক উপস'াপনা আমার চৈতন্যে চাঞ্চল্য এনে দেয়।
 
 এরপর প্রবন্ধকার ভাষা বিষয়ক কিছু তথ্য-উপাত্ত উপস'াপন করেন যা রীতিমত শিহরন জাগানিয়া ভীতিকর। উক্ত তথ্য মতে আগামী একশ বছরে বর্তমানের নব্বই শতাংশ ভাষাই মরে যাবে,তখন জীবিত ভাষার সংখ্যা থাকবে মাত্র ছয়শত একাশি টির মত (বর্তমানে জীবিত ভাষার সংখ্যা-প্রায় ছয় হাজার আটশত নয়টি মাত্র)। ভাষা মৃত্যুর এই হার যদি পরের শতকেও অব্যাহত থাকে তবে আগামী দুইশত বছর পর পৃথিবীতে জীবিত ভাষার সংখ্যা হবে আটষট্টি টি এবং তিনশত বছর পর ভাষা হিসাবে জীবিত থাকবে মাত্র ৬/৭ টি যদি না মনজুর রশীদের মত সৃষ্টিপ্রাণ তরুনেরা ভাষাকে বাচানোর আশায় কোন ভেলা না ভাসায়।

 প্রবন্ধকার এরপর যে ভাষা ভাষি মানুষের কল্যাণে বিশ্ববাসী তাদের মাতৃৃ ভাষার প্রথম এবং বৃহৎ প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেল সেই ভাষা ভাষি মানুষের দেশে বসবাসকারী পয়তাল্লিশটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর পঁচিশ লাখ মানুষের মাতৃ ভাষার অসি-ত্ব সংকটের করুন চিত্র উপস'াপন করেন যা উদ্বেগ জাগানিয়া। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার যে বাস-ব চিত্র তুলে ধরেছেন তা যেমনই নির্মম তেমনি করুন। কারণ কেবল প্রথম শ্রেণীতেই তিরিশ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝড়ে পরে,যার ধারাবাহিকতা পরবর্তীতেও অব্যাহত থাকে।  প্রবন্ধকার সকল শিশুর মাতৃ ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা লাভের যে জন্মগত অধিকার তার পরিপূর্ন বাস-বায়নের মধ্যেই এর সমাধান দেখেন।

 প্রবন্ধকার একুশ শতকের দ্বার প্রানে- এসে একুশের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে আমাদের বহু জাতি,বহু ভাষি ও বৈচিত্রময় সংস্কৃতির দেশে সবাই যেন স্বমহিমায় উন্নত চিত্তে বাচতে পারে তার জন্য অত্যাবশ্যক কিন' নিরব ক্রুসেডের ডাক দেন যা আমার ভাবাবেগে ভীষণ ভাবে অনুরনণ তোলে।

 প্রবন্ধকারের উপস'াপিত প্রতিটি তথ্য-উপাত্ত্বের সঙ্গে দৃঢ় ভাবে একমত পোষন করেই তাত্ত্বিক ব্যাপারে আমার অন্য মত (ভীন্ন মত নয়) বিনীত ভাবে উপস'াপন করছিঃ-

 প্রবন্ধকার শুরুতেই বলেছেন যে,সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে মানুষ নানা জাতি গোষ্ঠিতে বিভক্ত হয়ে যায় ফলে তাদের ভাষাতেও অনিবার্য ভাবে ভিন্নতা আসে। ধরে নেই যদি মানুষ জন্মগত ভাবে হাত,পা,নাক,চোখের মত মোবাইল ফোন কানে নিয়ে অথবা প্রজাপতির মত দূরবর্তী স্বগোত্রীয় সদস্যদের সাথে পারস্পরিক সংকেত বিনিময়ের ক্ষমতা নিয়ে জন্মাত তাহলে কি পৃথিবীতে এত ভাষা সৃষ্টির সূযোগ হতো? পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষা ভাষি মানুষের ভৌগলিক বিন্যাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে যে,সহজে যোগাযোগ স'াপনযোগ্য অঞ্চলের মানুষের ভাষা সাধারণত সমগোত্রীয়। আবার ভৌগলিক কারনে নির্দিষ্ট অঞ্চলের সীমাবদ্ধ এলাকার মানুষের ভাষা মোটামুটি একই। তাই একথা নিশ্চিনে- অনুমান করা যায় যে,মানুষে মানুষে পারস্পরিক যোগাযোগ যত বেশী হবে ভাষার ভিন্নতা তত কম হবে। প্রবন্ধকার তার উপস'াপিত তথ্যে দেখান যে,সময়ের সাথে সাথে পৃথিবীতে ভাষার সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান। আমার মনে হয় একথা ভাবা অযৌক্তিক হবে না যে,যোগাযোগ ব্যবস'ার নিরন-র উন্নয়নের ফলেই মানুষের ভাষাগত ভিন্নতা ক্রমহ্রাসমান। আগামীতে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে যোগাযোগ ব্যবস'া আরও উন্নত ও সহজ হবে,সেই সাথে মানুষের ব্যক্তিক পরিভ্রমনের পরিমান ও পরিধি অনেক বেড়ে যাবে। ফলে হয়তো দেখা যাবে যে, আগামী একশ বছরে প্রাক্কলিত হিসাবের চেয়ে অনেক বেশী ভাষা মরে যাবে এর অনিবার্য পরিনতি হিসাবে সংখ্যা লঘু ভাষা ভাষির সংখ্যা দ্রুত লয়ে কমতে থাকবে। এটা সময়ের কারণেই সময়ের জন্য সময় কর্তৃক সংগঠিত হবে। হয়তো মনজুর রশীদের মত সময় যোদ্ধারা এর গতি কিছুটা মন'র করতে পারবে কিন' গতি রোধ করতে পারবেনা সময়ের জন্যেই।

   প্রবন্ধকার সভ্যতার ক্রমবিকাশের কথা বলেছেন,কিন' আমার কাছে “সভ্যতা” শব্দটি একটি ভাসা ভাসা চলমান বিমুর্ত ধারনা মাত্র। এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণার অভাবে মনে আমার অস্পষ্ট প্রশ্ন শত। কারণ সভ্যতা যদি ক্রমবিকাশমানই হয় তাহলে বর্তমানে আমরা সভ্যতার কোন পর্যায়ে আছি? এর অনি-ম অবয়বই বা কি? এখন থেকে পাচশ বা হাজার বছর আগের মানুষের সভ্যতার ইতিহাস পড়ে আমরা যেমন বর্বরতার ইতিহাস পাই,ঠিক তেমনি এখন থেকে পাচশ বা হাজার বছর পরের মানুষেরা আমাদের বর্তমান সভ্যতার ইতিহাস পড়ে অসভ্যতাই বেশী দেখতে পাবে। আমরা অতীতের দিকে তাকিয়ে নিজেদের নিজেরাই সভ্য ভেবে তৃপ্তির ঢেকুর তুলি,কিন' সভ্যতার প্রকৃত মানদণ্ড আসলে কি? কোন দিকে যাচ্ছে আমাদের সভ্যতার বিজয় রথ?
যে কোন সময়ের পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের মনে সভ্যতার যে প্রতিরুপ, সভ্যতা আসলে সেই দিকেই ধাবিত। আমাদের বর্তমান সভ্যতা সেই রকম যে রকম আমরা নিকট অতীতে মনে ধারন করেছি। তাই মানুষের বোধ এবং বিশ্বাসে পরিবর্তনের মাধ্যমে সভ্যতার অভিযাত্রার কাংখিত লক্ষ্য নির্ধারন ও অর্জন সম্ভ্ভব। আমরা মনে প্রাণে সভ্যতার যেমন প্রতিরুপ বিশ্বাস করব,সময় সভ্যতাকে সেই দিকেই ধাবিত করবে। সত্যিকার অর্থে একটা সভ্য পৃথিবীর রূপ বা অবয়ব কি হবে,কি হতে পারে কিম্বা কি হওয়া উচিত সে ব্যাপারে আমার সুষ্পষ্ট প্রস-াবনা হচ্ছে-“সভ্য পৃথিবী হবে এক ভাষা, এক দেশ এবং এক মুদ্রার পৃথিবী”। কেননা বিশ্ববাসীকে ‘আমরা সভ্য’এই দাবী বা বোধ সৃষ্টির আগে তাদেরকে নিজেদের মধ্যে কোন না কোন মৌলিক বিষয়ে একাত্ব বোধ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে ভাষা,দেশএবং মুদ্রা সমত্ব বোধের পরম রূপ। আমার মতে পৃথিবীতে সর্বাধিক ব্যবহৃত অথহীন শব্দ হচ্ছে-‘আমরা’ (বা বিভিন্ন ভাষায় এর প্রতিরূপ)। কারণ বক্তার সম্পর্কে শ্রোতার কোন পূর্ব ধারণা না থাকলে বক্তার ‘আমরা’ শ্রোতার মনে কখনই কোন পরিস্কার অর্থ তৈরী করেনা। ভিন্ন ভিন্ন মানুষের কাছে ‘আমরা’ শব্দের ভিন্ন ভিন্ন অর্থ। ‘আমরা’ শব্দের প্রকৃত অর্থ সেই বোঝে যে তা বলে। পৃথিবীতে একটি মাত্র বা একগুচ্ছ(৬/৭টি) ভাষা জীবিত থাকলে অন্তত ভাষা বা ভাষাগত ক্ষেত্রে ‘আমরা’ মানে সবার কাছে একই রকম বা একই গোত্রের মনে হবে। কারণ মানুষের বুদ্ধি বৃত্তিক বিবর্তনের ফলে ভাষাগুলি কমবেশি সবাই জানবে। ভাষার ক্ষেত্রে বিশ্ববাসী একাত্ব বোধ করলে রাষ্ট্রীয় ভৌগলিক সীমা রেখার বিভাজন সত্ত্বেও পারস্পরিক নৈকট্য বোধ করবে এবং নিজেকে এই গ্রহের বাসিন্দা বলে ভাবতে পারবে,তখন মানুষ হবে শ্রেষ্ঠতম ‘আমরা’,সবাই বুঝবে সবার ‘আমরা’।

মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অভ্যস-তা, সে অবচেতন ভাবেই সব কিছুতে তার মত করে অভ্যস- থাকতে চায়। এমনকি ভাবনা-চিন-ার ক্ষেত্রেও তার একটা অভ্যস-তা তৈরী হয়। এই অভ্যস-তা মানুষের মনে কিছু বিশ্বাসের জন্ম দেয় যা তার চেতনাকে চালিত করে। যেমন আমরা সবাই জানি এবং মানি যে সময় চলমান,তা কখনো স'ীর নয়,এর গতি হ্রাস-বৃদ্ধি করা বা চলে যাওয়া সময় ফিরিয়ে আনা যায় না। তাই স্বাভাবিক ভাবেই সময়ের অতীত ও ভবিষ্যত কাল ছাড়া অন্য কোন কাল হতে পারেনা এবং বর্তমান কাল অসম্ভব, কারন সময় কখনো স'ীর হয় না। সময়ের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বর্তমান কাল অসম্ভব হলেও আমরা অতীত ও ভবিষ্যতের চেয়ে বর্তমানেই বেশী বিশ্বাসী এবং এর প্রভাব এত বেশী যে অতীত মনে থাকে না ও ভবিষ্যত মনে যায়গা পায়না। কাল্পনিক বর্তমান কালের অসি-ত্ব কেবল মাত্র আমাদের চেতনায় যা মানুষের অভ্যাস জনিত চিন-ার ফসল। এধরনের অবচেতন অভ্যস-তাই বৃহত্তর পরিসরে সভ্যতার কাঠামো নির্মান করে যা সচেতন ভাবে বিনির্মিত হয় বর্তমানের উপলব্ধিতে।


 আমার মতে পৃথিবী সভ্য হওয়ার পথে সবচেয়ে বড় অন-রায় হচ্ছে পৃথিবীর রাষ্ট্র ব্যবস'া। এই গ্রহ হচ্ছে রাষ্ট্র নামক বন্দীশালার সমষ্টি। অদৃশ্য পিঞ্জরে সবাই নিয়মের জিঞ্জির বাধা, সবাই এই রাষ্ট্র শৃংখলে আবদ্ধ। কিন' একজন সভ্য মানুষকে শৃংখলে আবদ্ধের প্রয়োজন হয় না,সে থাকবে সকল শৃংখলের উর্ধে তার অন-র্নিহিত অপার সম্ভাবনার সর্বোচ্চ বিকাশে মশগুল। তাই রাষ্ট্র ব্যবস'া ও সভ্য পৃথিবীর এক সাথে সহাবস'ান অযৌক্তিক ও অসম্ভব। কিন' মানুষের মগজে বর্তমানে রাষ্ট্র চিন-া এত প্রবল যে,এর বাইরে সে কোন চিন-াই করতে পারেনা,সে চিন-ার দাসত্বে সময়ের শৃংখলে বন্দী। অথচ এখনকার রাষ্ট্র গুলোকে এই গ্রহের স'ানীয় প্রশাসনিক ও উন্নয়নের একক ভাবলেই পৃথিবী রাষ্ট্রহীন হয়ে যায় তেমন কোন ভৌত বা গুরুত্বপূর্ণ  পরিবর্তন, পরিমার্জন, সংযোজন, বিয়োজন বা প্রতিস'াপন ছাড়াই। কারণ রাষ্ট্রের অসি-ত্ত্ব যতনা বেশী বাস-বে তার চেয়ে বেশী মানুষের মনে। এক্ষেত্রে মানুষের মানসিক পরিবর্তন ঘটালেই রাষ্ট্রের যন্ত্রণা থেকে সভ্যতা মুক্ত হয়, রাষ্ট্র মুক্ত হয় অপর রাষ্ট্রের জুজুবুড়ির ভয় হতে, অর্থনীতি মুক্ত হয় রাষ্ট্রের কাল্পনিক শত্রু হতে আত্নরক্ষার বিশাল ব্যয় বিলাস হতে। এখন পৃথিবীতে অসংখ্য দরিদ্র মানুষ থাকলেও সভ্য পৃথিবীতে থাকবেনা কোন দরিদ্র মানুষ, কেবল ‘অভাব’ ছাড়া পৃথিবীতে আর কোন কিছুর অভাব থাকবেনা। আমি ব্যক্তিগত ভাবে নিজেকে কোন দেশের বাসিন্দা ভাবার চেয়ে এই গ্রহের প্রায় সারে ছয়শত কোটি আমার প্রজাতির প্রাণীদের আমি একজন ভাবতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ বোধ করি এবং নিজেকে অনেক বেশী ঐশ্বর্য্যবান মনে হয়। কারণ এই মহাবিশ্বের মোট আয়তনের মাত্র চার শতাংশ ‘বস'’, আর সমস- বস'র মধ্যে উৎকৃষ্টতম বস'র সমাহার হচ্ছে পৃথিবী নামক এই গ্রহ যার জন্মই প্রাচুর্য্যে। পক্ষান-রে আমি যখন কোন নির্দিষ্ট দেশের বাসিন্দা তখন বড়ই দরিদ্র,অভাবী,অসহায়,বঞ্চিত, শোষিত এবং অনাহুত।

 ভাষাগত ভাবে মানুষ যদি একাত্ব হয়,মনের দেশাত্ববোধ যদি দুর নাও হয় তবু মুদ্রা তার ব্যবহারিক প্রয়োজনে একক বা একক সধারণ  গুচ্ছের (৪/৫টি) রূপ লাভ করবে। এটা সময়ের অনিবার্য পরিণতি যা সময় মতই ঘটবে। আগেই বলা হয়েছে আমি দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি পৃথিবী কোন না কোন একদিন একক ভাষার একক রাষ্ট্রে পরিণত হবে সভ্যতার পরিপূর্ন রূপ পরিগ্রহ করার জন্য আর এর অনিবার্য ফলাফল হিসাবে মুদ্রায় অভীন্নতা আসবে। বর্তমান পৃথিবীর দিকে তাকালে যে চিত্র পাওয়া যায় তা এই মতকে প্রচ্ছন্ন ভাবে সমর্থন করবে। কেননা বর্তমানে পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশই কোন না কোন আঞ্চলিক জোট ভূক্ত,সময়ের কল্যানে এবং প্রয়োজনে অদুর ভবিষ্যতে সমমনা এবং সমস্বার্থের আঞ্চলিক জোট গুলির মধ্যে  পারস্পরিক দুরত্ব কমতে থাকবে এবং কালের পরিক্রমায়  নিজেদের মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠবে। এই ধারা নিরন-র চলতে থাকবে,আর মুদ্রা তখন অসি-ত্বের প্রয়োজনেই একক সাধারন রূপ লাভ করবে।

উপরোক্ত বিষয়ে ভিন্ন মত পোষন করলেও একটা ব্যাপারে সবাই একমত পোষন করবেন যে,মানুষ হিসাবে আমরা সবাই ক্রমান্বয়ে সভ্য হচ্ছি এবং সভ্য হতেই আমরা চাই,সভ্যতার পথে আমরা সবাই বিরতিহীন  অভিযাত্রী। সভ্য পৃথিবী যদি একক ভাষার একক রাষ্ট্রই হয় তাহলে দ্রুত সভ্য হওয়ার একমাত্র পথই হচ্ছে এই এককীকরন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা। আর এক্ষেত্রে আমাদের প্রথম করনীয় হচ্ছে পৃথিবীতে ভাষাগত অভীন্নতা সৃষ্টি করা। প্রবন্ধকার তার বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন,যে কথা বলতে পারেনা তারও নিজের ভাষা আছে এবং একথার সত্যতা সম্পর্কে প্রমানের কোন প্রয়োজন পড়েনা। তার মানে সাধারন ভাবে আমরা  ভাষা বলতে যা বুঝি (মুখের কথা) তা ছাড়াও ভাব প্রকাশযোগ্য ভাষা হতে পারে এবং তা সার্বজনীন। কারণ বোবারা কারও কাছে ভাষা না শিখলেও তাদের ভাষা অনেকটা একই বা সমগোত্রের। শব্দই একমাত্র কথা বলার উপায় নয়,আর মানুষ উচ্চারিত সব শব্দই কথা নয়। যে শব্দ কানের সদর থেকে মনের অন্দরে প্রবেশ করতে পারে তাই কথা।যে জন যে ভাষা জানে না,সেই ভাষায় কথা তার কাছে শব্দ ছাড়া আর কিছুই নয়। আমি দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি পরিকল্পিত ভাবে বৈজ্ঞানিক উপায়ে এমন ব্যবহারিক ভাষা অবশ্যই উন্নয়ন করা সম্ভব যা সহজেই সবার কাছে বোধগম্য হবে,যা হবে বোবাদের ভাষা হতে উন্নত স-রের সরল ভাষা।

একটি কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আমরা প্রায়ই ভাষা ও সংস্কৃতিকে একাকার করে ফেলি,ভুলে যাই ব্যবধান। বোবার তো আমাদের মত তথাকথিত ভাষা নেই, তাই বলে কি তার কোন সংস্কৃতি নেই? ভাষা হচ্ছে আমাদের ভাব প্রকাশের মাধ্যম যার প্রকাশ শব্দ বা ইশারায়, আর সংস্কৃতি হচ্ছে মানুষের পৌনঃপুনিক আচরনগত বৈশিষ্ট্য যার প্রকাশ মানবিক আচারে। কোন বিশেষ গোষ্ঠির মধ্যে ভাষাগত ভীন্নতা থাকলেও তাদের সংস্কৃতি একই হতে পারে,আবার ভাষা এক হলেও থাকতে পারে তাদের সংস্কৃতিতে ভীন্নতা। সংস্কৃতি কোনক্রমেই ভাষা নির্ভর নয় বরং ভাষা নিরপেক্ষ।প্রবন্ধকার অত্যন- গুরুত্বপূর্ন একটি শব্দের অযত্ন ব্যবহার করেছেন। আর তা হচ্ছে ‘সমনাগরিকত’ ্ববোধ। কারণ সভ্য হওয়ার জন্য মানুষে মানুষে সমনাগরিকত্ব বোধই একমাত্র উপায়। সমভাষা বোধ বা ভাষাগত ঐক্য সমনাগরিকত্ব বোধকে আরও ত্বরান্বিত,শক্তিশালী,দৃঢ় এবং স'ায়ী করবে যা যে কোন ভৌগলিক সীমানায় প্রযোজ্য।

শিক্ষা দান এবং গ্রহনের ক্ষেত্রে ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। যে ভাষাতেই শিক্ষা দেয়া হোক না কেন তাকে কার্যকর,সার্থক এবং ফলদায়ক করতে হলে তা শিক্ষার্থীদের জন্য সহজে সাবলীল ভাবে বোধগম্য রুপে উপস'াপন করতে হবে। এক্ষেত্রে মাতৃ ভাষায় শিক্ষাদানই একমাত্র উপায় নয়,যদিও তা অন্যতম উপায়। যে ভাষাতেই শিক্ষা দেয়া হোকনা কেন তাকে সত্যিকার অর্থে কার্যকর করতে হলে শিক্ষার্থীদের জন্য তা সহজ বোধ্য এবং সহজগম্য ভাবে উপস'াপন করতে হবে। এক্ষেত্রে একটি বিষয় স্মরন রাখা দরকার যে, মানুষ যা কিছু শেখে তা তার পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমেই শেখে। আর মানুষের সব ইন্দ্রিয়ের গ্রহণ ক্ষমতা সমান নয়। সাধারন ভাবে মানুষের ইন্দ্রিয় সমুহের গ্রহণ ক্ষমতা নিম্নরূপঃ-

দর্শন ------------৮৪%
শ্রবন ------------১২%
স্পর্শ ------------০২%
স্বাদ ------------০১%
গন্ধ ------------০১%
মোট============১০০%

উক্ত তথ্যের সমর্থনে বাস-ব উদাহরন হচ্ছে আমরা যত দুর পর্যন- দেখতে পাই তার চেয়ে কম দুরত্বে শুনতে পাই,স্পর্শ করতে পারি আরও কম দুরত্বে,স্বাদ আর গন্ধ নিতে পারি একেবারেই নিকটের। উপরোক্ত তথ্য হতে একথা নিশ্চিনে- বলা যায় যে,শিক্ষা ব্যবস'া যত বেশী দর্শন নির্ভর হবে তা শিক্ষার্থীদের জন্য গ্রহণ করা তত সহজ হবে,কারণ মানুষের দর্শন ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতা অন্য যে কোন ইন্দ্রিয়ের চেয়ে বেশী। তাই ভাষাগত ভিন্নতার চেয়ে উপস'াপনগত ভিন্নতাই বেশী গুরুত্বপূর্ন। বরং এ প্রসঙ্গে সমপ্রতি কানাডার ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা তিরিশ থেকে আটাশি বছর বয়সী একশত চার জন মানুষের উপর পরিচালিত জড়িপে একাধিক ভাষা সংক্রান্ত ব্যাপারে যে ফলাফল পান তা স্মরন করা যেতে পারে। গবেষকরা বলেন যে,ছোট বেলায় মাতৃ ভাষা শেখার পর যদি বেশ দ্রুত দ্বিতীয় কোন ভাষা শেখা যায় তাহলে তা পরবর্তী জীবনে মানসিক দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। দ্বিতীয় ভাষাটি মসি-স্কের ভাষা অঞ্চলে বেশ কিছু স্নায়ুবিক সার্কিট তৈরী করে যা স্মৃতিচারন,গননা,বিষয় বস'র উপলব্ধি প্রভৃতি বিষয়ে উৎকর্ষতা সাধন করে। লাভের উপর লাভ হিসাবে নিউরনের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, ফলে ভাষাগত অভিন্নতা কোন ভাবেই তার সংস্কৃতি বা শিক্ষাকে নেতিবাচক ভাবে প্রভাবিত করেনা বরং তা সংস্কৃতি ও শিক্ষার ব্যাপকীকরনের সহায়ক ক্ষেত্র তৈরী করে। সভ্যতার ক্রমবিকাশের এই নিরন-র যাত্রাকে ত্বরান্বিত করতে হলে যত বেশী এবং যত দ্রত সম্ভব অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র  ভাষা ভাষি মানুষদের তুলনামুলক বৃহত্তর ভাষা ভাষি মানুষদের ভাষার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে যা প্রকৃতিগত ভাবেই অবিরাম ঘটে চলেছে যাদৃচ্ছিক ভাবে।

ভাষাগত ঐক্যের মাধ্যমে পৃথিবীর সভ্যতার পথে পরিভ্রমনের গতিকে ত্বরান্বিত করতে হলে আদি বাসি বা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠি বা সংখ্যা লঘু ভাষা ভাষিদের আদিম চিন-ন বৃত্তে আবদ্ধ রেখে আদি বাসি বানিয়ে রাখার চিরস'ায়ী বন্দোবস- না করে ভাষাগত ভাবে তাদেরকে মূল স্রোত ধারায় আনতে হবে।এতে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি তো ক্ষতিগ্রস' হবেই না বরং অন্যেরা সেটা ভাষাগত ভাবে সহজেই বুঝতে পারলে পরস্পরের সংস্কৃতির প্রতি সহানুভূতিশীল হবে। রাষ্ট্রের এককীকরন প্রক্রিয়া বর্তমান সভ্যতার কলংক টিকা সামরিক শক্তিকে ক্রমান্বয়ে দূর্বল করতে করতে বিলুপ্ত করবে যা এই গ্রহের সৌন্দর্য্য ও ঐশ্বর্য্যকে মানষের জন্য আরও সহজগম্য ও উপভোগ্য করবে। মুদ্রার এককীকরন এবং তার ধারাবাহিকতায় ডিজিটালকরন পৃথিবীর আর্থিক ও অর্থনৈতিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার সহায়ক ক্ষেত্র তৈরী করবে।
আমাদের আদি পুরুষের জস্মের মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল মানব জাতির সভ্যতার পথে নিরন-র এ যাত্রা। মহাকালের পরিক্রমায় মানুষের বুদ্ধি বৃত্তিক ও মানবিক উৎকর্ষতা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে স'ানান-রিত হয়ে তা বর্তমান কালে ও বর্তমান রুপে আমাদের সামনে উপস'াপিত হয়েছে আগামী প্রজন্মের নিকট সঞ্চালনের জন্য। প্রকৃত পক্ষে কোন মানুষই বিচ্ছিন্ন কোন মানুষ নয়। জেনেটিক্যালি মানুষের পূর্ব পুরুষের মানসিক উৎকর্ষতা উত্তর পুরুষে স'ানান-রিত/সঞ্চালিত হয়। সভ্যতার ক্রমবিকাশের অবিরাম এই যাত্রায় রিলে দৌড়ের মত এক প্রজন্ম যেখানে শেষ করে পরের প্রজন্ম সেখান থেকে শুরু করে। মানুষের সঙ্গে পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণীর পার্থক্য আসলে এখানেই। আজকের প্রজন্মের মনে সভ্যতার যে প্রতিরূপ, আগামী প্রজন্মের জীবনধারায় তার প্রকাশ অবধারিত। আর সময় তার সাময়িক প্রয়োজনে রশীদ ব্রাদার্স এর মত সন-ান ও একশন এইডের মত সংগঠন তৈরী করে সভ্যতার দিকপাল হিসাবে। তাদের চোখে বিশ্ব দেখে সভ্যতার বৈশ্ব্যিক রূপ। আর বিশ্ববাসী সেভাবেই সভ্যতাকে অবচেতন চেতনায় ধারন করে। আর সময় সেভাবেই সূযোগ সৃষ্টি করে সময় যোদ্ধাদের জন্য।

পরিশেষে সম্মিলক রশীদ ভাতৃদ্বয়কে মানবতার কল্যাণে তাদের আন-রিক প্রচেষ্টার জন্য অন-হীন শুভেচ্ছা জানিয়ে,মানুষের অসীম সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে সভ্যতার যাত্রায় এ বিশ্বকে অবিরাম সামনে নিয়ে যাওয়ার নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রামে একশন এইডের ব্রতকে অকুন্ঠ সমর্থন জানিয়েই আলোচ্য প্রবন্ধের প্রস-াবনা নিয়ে আমি ব্যাক্তিগত ভাবে খুবই দ্বিধান্বিত, চিনি-ত, শংকিত এবং আশাহত এই ভেবে যে, এর বাস-বায়ন আমাদের সভ্যতার অভিযাত্রাকে সামনের দিকে নিয়ে যাবে নাকি সময়ের উল্টো স্রোতে চলার মত আমাদের পেছন দিকে টেনে ধরে রাখবে?

No comments:

Post a Comment